স্বাধীনতাকামী তিব্বতী ও ঘটনার ঘনঘটা

জান-ই-আলম জান-ই-আলম প্রকাশিত: ১২:৩৫ পিএম, ১১ এপ্রিল ২০২০
স্বাধীনতাকামী তিব্বতী ও ঘটনার ঘনঘটা

১০ মার্চ। ক্লান্ত-শ্রান্ত দেহের কুম্ভকর্নের ন্যায় ঘুম ভাঙতে ভাঙতে সকাল ১০টা। তাছাড়া এ দিন বাংলাদেশের ম্যাচ ছিল না বলে ঘুমটা প্রলম্বিত হয়েছিল। এদিকে সকাল থেকে ধর্মশালার আকাশে সূর্যমামার দেখা মিলেছে। রোদ চিকচিক করছে। মিঠে রোদের তাপ শরীরে উষ্ণতা যোগাচ্ছে। হোটেলেই প্রাতরাশের পর মোবাইল ফোনে রিচার্জ করতে বের হয়েছিলাম আমরা ক’জন।

পাহাড় কেটে বানানো রাস্তা বেয়ে উপরে উঠছি। এসব রাস্তা হলো এমন যে, আপনি উপরে ওঠে হোটেলে কিছু খাবেন, দেখা যাবে আবার নামতে নামতে হয়তো পেটে ক্ষুধা লেগে যেতে পারে।

রিচার্জের কাজ শেষ না হতেই দোকানে দাঁড়ানো অবস্থায় হঠাৎ গর্জনের শব্দ কানে আসল। পেছন ফিরতেই দেখা গেল, রাস্তায় সারিবদ্ধভাবে হাজারো মানুষ হেঁটে যাচ্ছে। গর্জনটা তাদেরই কণ্ঠ নিসৃত। সমস্বরে স্লোগান দিচ্ছেন তারা। সেখানে হিন্দি ভাষার সঙ্গে অন্য ভাষারও যোগ আছে। হিন্দির বাইরে আরেকটা ভাষা হয়তো তিব্বতের।

‘দালাইলামা জিন্দাবাদ, দালাইলামা জিন্দাবাদ’, ‘হাম চাইয়ে তিব্বত কী আজাদী, তিব্বত কী আজাদী ভারত কা সুরক্ষা’ -এসব ছাড়াও অনেক স্লোগান ছিল। একটা স্লোগানের বাংলা অর্থ করলে দাঁড়ায় এমন, ‘জীবন দেব, রক্ত দেব, তবু দেশ ছাড়বো না।’ শরীর, রক্ত জাগানিয়া স্লোগানই সব। অন্তরের ভাষাও বলা চলে।

তিব্বতের পতাকা হাতে আবাল, বৃদ্ধ-বনিতার মিছিলের লাইনটা শেষই হচ্ছে না। চলছে তো চলছেই। স্কুল-কলেজগামী ছাত্র-ছাত্রী ইউনিফর্ম নিয়ে মিছিলে ছিল। বৌদ্ধ ভিক্ষুদের পোশাকেও ছিলেন হাজারও জনতা। দ্রোহের স্লোগান হলেও তিব্বতের মানুষদের মিছিল চলাকালীন শৃঙ্খলা, উদ্দীপনা, জন্মভূমির প্রতি প্রতিজ্ঞা বিশেষভাবে চোখে পড়েছে।

মিছিলের উদ্দেশ বুঝতে দেরি হয়নি। কিন্তু ঠিক এদিনই কেন এমন মিছিল? অনেকের সঙ্গে চেষ্টা করেও কথা বলা গেল না। সময় নেই বলে দ্রুতপায়ে হেঁটে, দৌড়ে তারা চলে যাচ্ছে সবাই অগ্রগামীদের সঙ্গে। মিছিলে অনেক বিদেশি মানুষও দেখা গেল। যারা সংহতি জানাচ্ছেন তিব্বতের মানুষদের দাবির সঙ্গে। আমাদের কৌতূহল মেটালেন তিব্বতী নন এমন এক ভারতীয়। তবে তার নামটা জানা হয়নি। তিনি আবার মিছিলের অংশ। মিছিলে ছিলেন তিব্বতের বাহারী সাজের মানুষদের সঙ্গে।
sportsmail24

তিনি জানালেন, প্রতি বছরই এ মিছিল হয়। তিব্বতের স্বাধীনতাকামী মানুষ প্রতি বছরই এটা করে। তারিখটা ১০ মার্চ। ১৯৫৯ সাল থেকে এ মিছিল নিয়মিত হয়ে আসছে। আসলে তিব্বত দুই অংশে বিভক্ত। একটা অংশ শাসন করে চীন। আরেকটা অংশ ভারত। চীন চায় গোটা তিব্বত তাদের সঙ্গে যুক্ত হোক। ভারতের সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলছে তারা। কিন্তু ভারতের অংশে থাকা তিব্বতের লোকজন চায়, হয় ভারতের সঙ্গে থাকবে নয়তো নিজেরা আলাদা দেশ হবে। তবে ভারত ছেড়ে চীনে ভিড়তে চায় না তারা। তাই প্রতি বছর এ মিছিল করে নিজেদের প্রাণের কথা জানায় তিব্বতীরা।

তিব্বতের জাতীয় বিদ্রোহের দিন ১০ মার্চ। ১৯৫৯ সালের এ দিনেই তিব্বতের রাজধানী লাসায় বিদ্রোহের সূত্রপাত হয়। লাসা এখনও চীনের দখলে। ধর্মশালায় পড়েছে লাসার কিয়দাংশ। ওই দিন তিব্বতীদের ধর্মগুরু দালাইলামাকে কিডন্যাপের হুমকি দিয়েছিল চীন। দালাইলামাকে বাঁচাতে সেদিন ৩ লাখ তিব্বতী জড়ো হয়েছিল। ঘিরে রেখেছিল দালাইলামার বাসা। তখন অনেক সাধারণ তিব্বতী মারা গিয়েছিল চীনের আর্মির সঙ্গে লড়াইয়ে। তারপর থেকেই দিনটাকে নিজেদের বিদ্রোহের, স্বাধীনতার দাবির মঞ্চ হিসেবে পালন করে আসছে তিব্বতের লোকজন।

মিছিলে অংশ নেওয়া তিন তিব্বতী তরুণী বসেছিল এক দোকানের সামনে। তাদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছিলাম। দু’জন মুখ ঘুরিয়ে নিল। পরে একজন রাজি হলো। কিছুটা কথা হলো ওর সাথে। ছবি তোলা হলো। তার কাছে চাইতেই নিজের হাতে থাকা তিব্বতের জাতীয় পতাকা আমাকে উপহার দেয় সেই তরুণী। যা এখনও আমার কাছে মধুর স্মৃতি হয়ে টিকে আছে।

তিব্বতীদের মিছিলটা পরে জড়ো হয় ধর্মশালার শহরের অভ্যন্তরে এক জায়গায়। নেতাদের উজ্জীবনী বক্তব্যের পর শেষ হয় দিনের কর্মকাণ্ড। তিব্বতিরা ফিরে যায় আপন ঘরে। তিব্বতের স্বাধীনতা কবে হবে তা নিশ্চিত নয়। তবে দেশের জন্য তাদের টানটা অকৃত্রিমই বটে।

কয়েকট ঘণ্টা পার হয় তিব্বতীদের মিছিল দেখে। হোটেলে ফিরেই জিম্বাবুয়ে-স্কটল্যান্ড, হংকং-আফগানিস্তান ম্যাচ ও বাংলাদেশের ঐচ্ছিক অনুশীলন দেখতে আমরা স্টেডিয়ামে রওনা হই। সেদিন জিম্বাবুয়ে ও আফগানরা ম্যাচ জিতেছিল অনায়সে।

একটা বিশ্বকাপ শুরু হয়েছে। কিছু না কিছু ঘটনা তো থাকতেই হয়। একেবারে নিরুত্তাপ হওয়াটাই যেন বেমানান! ঘটনার ঘনঘটা ওইদিনই শুরু। স্টেডিয়ামে যাওয়ার আগেই খবর চাউর হলো ডাচদের বিরুদ্ধে ম্যাচের পর বাংলাদেশের বাঁহাতি স্পিনার আরাফাত সানির বোলিং অ্যাকশন নিয়ে আম্পায়াররা রিপোর্ট করেছেন।

খানিক পর গুঞ্জন ছড়ালো তাসকিন আহমেদকে নিয়েও। খবরটা নিশ্চিত করেন ওই ভেন্যুতে আইসিসির মিডিয়া ম্যানেজার রাবিদ ইমাম (তিনি বিসিবিরও মিডিয়া ম্যানেজার। বিশ্বকাপ চলাকালীন আইসিসিতে কর্মরত ছিলেন)। তবে তখন পর্যন্ত তার ভাষ্যমতে, সেটি ছিল নিছকই আম্পায়ারদের সন্দেহ।

এ খবর শোনার পর চাঞ্চল্য তৈরি হয় বাংলাদেশের সাংবাদিকদের মাঝে। মাঠে গিয়ে পাওয়া গেল বাংলাদেশ দলকে। তবে সংখ্যায় কয়েকজন ক্রিকেটার এসেছেন। তাও আবার একটা নিরাপত্তা বেষ্টনীতে হাথুরুসিংহে তাদের অনুশীলন করাচ্ছেন। ওই অবস্থা থেকে কিছুই উদ্ধার করা গেল না। আইসিসিও কোনো সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বিষয়টা নিশ্চিত করছে না। তাই একটা দোলাচালেই আমাদের সময় কাটছিল।

বাংলাদেশের অনুশীলন শেষ হতেই আইসিসির সংবাদ বিজ্ঞপ্তি আসে। টাইগার কোচ হাথুরুসিংহে যারপরনাই বিস্মিত হয়েছেন সানি ও তাসকিনের বোলিং অ্যাকশনে সন্দেহের কথা জেনে। তার দৃষ্টিতে দু’জনের বোলিং অ্যাকশনই শুদ্ধ ছিল। তবে সেদিকে চিন্তিত না হয়ে আগামী ম্যাচেই মনোযোগ দেওয়ার কথা জানিয়েছিলেন হাথুরুসিংহে। উত্তাপ কমলেও তাসকিন-সানিকে ছাড়া বাংলাদেশের বোলিং আক্রমণ নিয়ে ভাবনা থামছিল না। কারণ দু’জনেই দারুণ ফর্মে ছিলেন। বিশেষ করে তাসকিন।

১০ মার্চ দুটি ম্যাচ শেষ হওয়ার পরই শুরু হয় বৃষ্টি। ধর্মশালার আকাশে অঝোর বর্ষণ। কাজ শেষে হোটেলে ফেরার অপেক্ষায় আমরা। বৃষ্টির কারণে প্রেস বক্স থেকে বের হওয়া যাচ্ছে না। চলে গিয়েছিল বিদ্যুৎও। তারপর বৃষ্টির পরিমাণ কমলে আমরা দৌড়ে দৌড়ে গিয়ে গাড়িতে ওঠি।

অবশ্য বৃষ্টির আমি একবার বের হয়েছিলাম প্রেস বক্স থেকে। তখন প্রাকৃতিক কর্ম সারতে যাওয়ার সময় আমি সিঁড়িতে পেয়ে যাই অ্যালান উইলকিনসকে। সেখানেই তার সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ কথা হয়।

হালের ক্রিকেট দুনিয়ায় ধারাভাষ্যকার হিসেবে অন্যতম পরিচিত মুখ উইলকিনস। আর ধারাভাষ্যের কারণেই ভদ্রলোককে চিনি অনেক বছর ধরে। বাংলাদেশেও অনেকবার গেছেন ধারাভাষ্য দিতে।

১৯৫৩ সালে কার্ডিফে জন্মেছেন তিনি। ইংলিশ কাউন্টি ক্লাব গ্লুস্টারশায়ার ও গ্ল্যামারগনের হয়ে খেলেছেন। ছিলেন বাঁহাতি পেসার। সাত বছরের ক্যারিয়ারে ৪০০ উইকেট নিয়েছেন। কাঁধের ইনজুরির কারণে ছাড়তে হয়েছিল ক্রিকেট।

ক্রিকেটার থেকে ধারাভাষ্যকার। এটা স্বাভাবিকই বটে। তবে উইলকিনসের জীবন এর চেয়ে অনেক বেশি বর্ণাঢ্য। ৬২ বছর বয়সী এ ইংলিশম্যান রাগবিও খেলেছিলেন। খেলাধুলার পাঠ চুকানোর পর সাংবাদিকতা করেছেন। দক্ষিণ আফ্রিকা ব্রডকাস্টিং করপোরেশনের (এসএবিসি) ইংরেজি বিভাগের ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক হিসেবে সাংবাদিকতার কাজ শুরু করেন। সেখানে সেরা ক্রীড়া সাংবাদিকের পুরস্কারও জিতেছিলেন।

১৯৮৭ সালে চলে আসেন বিবিসিতে। পরে রাগবি, টেনিসের ধারাভাষ্য দিয়ে আসেন ক্রিকেটের ধারাভাষ্য জগতে। উইম্বলডনেও ধারাভাষ্য দিয়েছেন তিনি। আর হ্যাঁ, গলফেও ধারাভাষ্যের অভিজ্ঞতা আছে তার। সেসব শেষ করে ক্রমেই আপন ভুবন ক্রিকেটে যুক্ত হয়েছেন তিনি।

পেশার কারণে বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের ভালো করে চিনেন। বাংলাদেশ শক্তিশালী হলেও গ্রুপ পর্বে ভালো লড়াইয়ের আভাস ছিল। উইলকিনসের বিশ্বাস ছিল, নির্বিঘ্নেই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সুপার টেন পর্বে খেলবে বাংলাদেশ। তাসকিনের অনেক প্রশংসা করেছিলেন। বাংলাদেশের তরুণদের নিয়ে দারুণ আশাবাদী শোনাল তার কণ্ঠ।

ক্ষণিকের আলাপে তিনি বলেছিলেন, দলে অনেক তরুণ ক্রিকেটার আছে। এরা যত দ্রুত আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে মানিয়ে নিতে পারবে দলটা ততই ভালো করবে।

উইলকিনসের সঙ্গে ছোট্ট আলাপচারিতা অশান্ত মনকে কিছুটা প্রশান্তি যুগিয়েছিল। বৃষ্টি মাথায় নিয়েই হোটেলে ফেরা এবং রাতের খাবার খেতে যেতে হলো বাইরে। কাকভেজা হয়ে ফিরে আসা।

ধর্মশালায় দ্বিতীয় রাত। ক্লান্তি ভুলে হোটেলে বিভিন্ন রুমে আড্ডা হলো কিছু সময়। আমরা বেশিরভাগই মাঝ রাত পেরিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম।

চলবে...


শেয়ার করুন :


আরও পড়ুন

অপ্রতুল প্রস্তুতি, বড় অভিযাত্রা

অপ্রতুল প্রস্তুতি, বড় অভিযাত্রা

বন্ধন এমন বিশ্বাস যেমন

বন্ধন এমন বিশ্বাস যেমন

মিশন ধর্মশালা

মিশন ধর্মশালা

ধর্মশালার শীতলতা ও মনোহর প্রকৃতি

ধর্মশালার শীতলতা ও মনোহর প্রকৃতি