রানা চলে যাওয়ার ১৩ বছর

মমিনুল ইসলাম মমিনুল ইসলাম প্রকাশিত: ০২:২৭ পিএম, ১৬ মার্চ ২০২০
রানা চলে যাওয়ার ১৩ বছর

মানুষ মরণশীল। জন্মালে মরতে হবে এটা অবধারিত। এই নিয়ে সন্দিহানের কোন অবকাশ নেই। তবে কিছু কিছু মৃত্যুর গল্প কিংবা কিছু মানুষের চলে যাওয়া মনের গহীনে দাগ লেগে যায়। তেমনি বাংলাদেশ ক্রিকেট ভক্তদের মনে দাগ লেগে আছে সম্ভাবনাময় এক তরুণের চলে যাওয়া। নাম মানজারুল ইসলাম রানা। বিধাতার ডাকে পৃথিবীর সর্বকনিষ্ঠ টেস্ট ক্রিকেটার হিসেবে পৃথিবীর মায়া ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছেন পরপারে।

সময়টা ১৬ মার্চ, ২০০৭। স্থানীয় একটি ম্যাচ খেলতে হাসি মুখেই বাসা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন রানা। ম্যাচ শেষে আর হাসি মুখে ফেরা হয়নি রানার। ম্যাচ শেষ করে প্রতিদিনের মত বাইক চালিয়ে যাচ্ছিলেন চুকনগরে, খুলনার বিখ্যাত চুই খেতে আর তার পিছনে উদীয়মান ক্রিকেটার সেতু। সাই সাই করে চলছে বাইক। বাইক প্রিয় মানুষ ছিল মাঞ্জারুল ইসলাম রানা। মাশরাফি সবসময় বলতো 'সাবধানে চালাস রানা'। তখন কি একবার রানা ভেবেছিল প্রিয় মাশরাফির কথাটি।

বাইক নিয়ে রানা তখন খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার বালিয়াখালি ব্রিজের কাছে হঠাৎই বাইকের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বসে রানা। নিয়ন্ত্রণ হারালে বাইকটি ব্রিজের সাথে গিয়ে লাগে। এক্সিডেন্টের পর সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন রানা। তার পিছনে থাকা সাজ্জাদুল ইসলাম সেতু সে সময়ের জন্য বেঁচে গেলেও স্থানীয় হাসপাতালে নেয়ার পর মারা যান তিনিও।

খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার বালিয়াখালে যখন শোকের ছায়া তখন পোর্ট অফ স্পেনে পরাক্রমশালী ভারত বধের স্বপ্ন বুনছে সাকিব, তামিম, মুশফিক, মাশরাফি ও হাবিবুল বাশাররা। নবম বিশ্বকাপে দ্বিতীয় বারের মত বিশ্বকাপ খেলছে বাংলাদেশ তাই একটু বেশিই উত্তেজিত ছিল বাংলাদেশের খেলোয়াড়েরা। সেই সাথে আজকের সাকিব, তামিম,  মুশফিকদের জন্য ছিল প্রথম বিশ্বকাপ তাই তো বাড়তি উত্তেজনা ছিল তাদের মাঝে।

হঠাৎ অধিনায়ক হাবিবুল বাশার সুমনের কাছে একটা কল এল। ফোনের ওপার থেকে রানার কথা বলছিল কেউ একজন। ফোনের ওপারের কথা গুলো শুনে হঠাৎই মলিন হয়ে যায় বাশারের হাস্যজ্জ্বল মুখটা।তখন সবাই এগিয়ে গিয়ে জানতে চাইল কি হয়েছে বাশার ভাই। বাশার মাশরাফিকে খুঁজতেছিলেন, দেখলেন দুরে সবার সাথে হাসি ঠাট্টায় মেতে আছেন। বাশার ভাবছে কি করে মাশরাফিকে বলবো এই কথা। রানা মাশরাফির শুধু সতীর্থ ছিল না ভালো বন্ধুও ছিল বটে। সবাই তো বলতো ওরা দুইজন ভাই।

বাশার বলছিলেন না তবে পরোক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে শুধু ছোট্ট করে উত্তর দিলেন রানা নেই! সবাই বলে উঠলেন কী বলেন? বাশার ভাই কী বলেন? বললো, হ্যাঁ, চুকনগরে যাওয়ার সময় বাইক এক্সিডেন্ট করে। এমন উত্তর শোনার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না কেউ ই তা তাদের মুখ দেখেই বোঝা গিয়েছিল। রাজ্জাক, রাসেলরা তো হাউমাউ করে কাঁদতেছিল সাথে সিনিয়ররাও কাঁদতেছিল, ছোটরা কি করবে তা বুঝে উঠতে পারছে না তবে তারাও চিনতো রানাকে।

মাশরাফিকে হাতের ইশারায় কাছে ডাকছিলেন বাশার। মাশরাফি কাছে না এসে আস্তে আস্তে রুমে চলে গিয়েছিলেন। রুমে গিয়ে লাইট অফ করে কান্নায় ছলছল করা চোখ নিয়ে শুয়ে পড়লেন। সবাই তখন ভয় পেয়ে গিয়েছিল মাশরাফি কিছু না করে বসে। মাশরাফির রুমের আলাদা একটা চাবি ছিল সৈয়দ রাসেলের কাছে। একটু পড়েই মাশরাফির রুমে আসলেন সৈয়দ রাসেল। এসেই লাইট জ্বালালেন। মাশরাফি বললেন লাইট জ্বালাস না। রানা অন্ধকার না হলে ঘুমাতে পারতো না। এইটা বলেই রাসেলকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলেন মাশরাফি। রানা, এইটা  কি করলি!

sportsmail24

১৭ই মার্চ রানার শোককে শক্তি বানিয়ে খেলেছিল বাংলাদেশ দল।সেই ম্যাচটা জিতেছিলো ভারতের মতো পরাশক্তির বিপক্ষে। রানার বন্ধু মাশরাফিও ছিলো পার্ফমেন্সে উজ্জ্বল।মূলত রানার জন্যই জিততে হবে এমনটা প্রতিজ্ঞা করেই মাঠে নেমেছিল বাংলাদেশ দল। শুধু ওইদিন নয় ২০১২ সালের এশিয়া কাপে শচীনের ১০০তম সেঞ্চুরি করার ম্যাচও আজকে দিনে রানার স্মরণে জিতেছিল বাংলাদেশ। ২০১৮ সালের নিদাহাস ট্রফির কথা মনে আছে? আজকের এই দিনেই রিয়াদের সেই ছক্কা? সেটাও আজকের এইদিনে। আজকের দিনে হয়তো টাইগারদের সাথে মাঠে থাকে রানার আত্মাও।

মাশরাফি আর রানা ছিল ঠিক উল্টো স্বভাবের দুজন মানুষ। তবুও তারা অনেকদিন এক সাথে এক রুমে থেকেছেন। মাশরাফির বিছানার পাশে একটু আলো না হলে তিনি ঘুমাতে পারেন না। তার উল্টো চিত্র রানার ক্ষেত্রে রুমে একটু আলো থাকলেও ঘুমাতে পারতেন না। অন্ধকার খুব প্রিয় ছিল রানার। দরজার ফাঁক দিয়ে একটু আলো আসলেও সেখানে কাপড় গুছে দিয়ে রুম অন্ধকার করে ঘুমাতেন।

রানা সবসময় মাশরাফির পরে ঘুমাতেন। তার একটা কারণ ছিল। রানা বুদ্ধি বের করে মাশরাফিকে বলেছিল তুই আগে ঘুমা আমি পরে লাইট অফ করে দিয়ে ঘুমাবো। এভাবেই চলতো তাদের ঘুমের কাজটা। মাঝে মাঝে মাশরাফি অবশ্য ইচ্ছা করেই রাত জেগে থাকতেন কিন্তু ঐ দিকে ঘুমে ঢুলে পড়তো রানা। মাশরাফি হয়তো আজও লাইট জ্বালিয়ে মাঝরাতে ঘুমান,হয়তো এখনও মাঝরাতে রানার কথা মনে হলে বলে উঠেন রানা, তুই এইটা কি করলি! রানা ভাই আমার!

রানার ক্রিকেট ক্যারিয়ারঃ-

২০০০ সালের ২২ নভেম্বর প্রথম-শ্রেণির ক্রিকেটে খুলনা বিভাগের হয়ে রানার অভিষেক ঘটে। ঐ ম্যাচে তাকে ব্যাট করতে হয়নি।এরপর ৩০ জানুয়ারি ২০০৩ এবং ৮ ফেব্রুয়ারি ২০০৫ এর মধ্যে রানা ঘরোয়া ক্রিকেট খেলেননি।২০০৩ সালের ৭ নভেম্বর চট্টগ্রামে একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে রানার অভিষেক ঘটে।মোহম্মদ রফিক এর স্থলাভিষিক্ত হয়ে তার অভিষেক হয়। তিনি তার তৃতীয় বলেই মাইকেল ভনকে আউট করেন। তিনি প্রথম বাংলাদেশি ক্রিকেটার যিনি তার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে প্রথম ওভারেই উইকেট নিয়েছেন।

sportsmail24

২০০৪ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে রানার টেস্ট অভিষেক ঘটে। ওই ম্যাচে তিনি ২০.২ ওভার বল করে ৬৬ রান দিয়ে ২ উইকেট নেন। টেস্টে তার প্রথম শিকার শন আরভিনের উইকেট। ওই ম্যাচের ১ম ইনিংসে অপরাজিত ৩৫* ও ২য় ইনিংসে ৩২ রান করেন। ২০০৫ সালের জানুয়ারির ২৬ ও ২৯ তারিখে টানা দুটি ম্যাচে ৩৪ রানে ৪ উইকেট ও ৩৬ রানে ৪ উইকেট সহ ১ ক্যাচ ও ব্যাট হাতে ৬ ও ১৫* রান করে বাংলাদেশকে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে দুটি ম্যাচ জিতান। আর দুটি ম্যাচেই ম্যাচসেরা খেলোয়াড় ছিলেন রানা। বাংলাদেশের হয়ে ৬টি টেস্ট ও ২৫ টি ওয়ানডে খেলেন মানজারুল ইসলাম রানা।

টেস্ট ক্রিকেটে ২৬ বছরের নিচে পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে গেছেন এমন ক্রিকেটারের সংখ্যা ৭ । সবচেয়ে কম বয়সে মারা গিয়েছেন বাংলাদেশের মানজারুল ইসলাম রানা। ২০০৭ সালের ১৬ মার্চ রানা মারা গিয়েছিল মাত্র ২২ বছর ৩১৬ দিন বয়সে। রানা মারা যাওয়ার আগে এমন নিষ্ঠুর রেকর্ডের মালিক ছিল অস্ট্রেলিয়ার আর্কি জ্যাকসনের। ১৯৩৩ সালের ১৬ ফেব্রয়ারি জ্যাকসন মারা গিয়েছিল মাত্র ২৩ বছর ১৬৪ দিন বয়সে।

এছাড়া বেন হলিওকে (২৪ বছর ১৩২ দিন), সিরিল ক্রিস্টিয়ানি (২৪ বছর ১৫৮ দিন), ট্রেভর মাদোন্ডো (২৪ বছর ২০১ দিন), গুস কেম্পিস (২৪ বছর ২৮৮ দিন) ও সর্বশেষ ফিল হিউজ (২৫ বছর ৩৬২ দিন) বয়সে মারা যান।

বিধাতার নিয়মে আমাদের মাঝে থেকে হারিয়ে গেল মানজারুল ইসলাম রানা। আমরা হারিয়ে ফেললাম সম্ভাবনাময় একজন অলরাউন্ডারকে। মানজারুল ইসলাম রানা বেঁচে থাকলে হয়তো সাকিব আল হাসানের মত আমাদের আরও একজন বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার থাকতো। ওপারে ভালো থাকবেন মানজারুল ইসলাম রানা।


শেয়ার করুন :


আরও পড়ুন

জীবনযুদ্ধে হার না মানা স্যাম ওয়ার্ডের গল্প

জীবনযুদ্ধে হার না মানা স্যাম ওয়ার্ডের গল্প

পঙ্গুত্বকে হার মানিয়ে সফল স্বর্ণজয়ী সাইকেলিস্ট ভোগেল

পঙ্গুত্বকে হার মানিয়ে সফল স্বর্ণজয়ী সাইকেলিস্ট ভোগেল

‘এগারো’ ভিন্ন ভিন্ন গল্প জুড়ে দিলে ইতিহাস

‘এগারো’ ভিন্ন ভিন্ন গল্প জুড়ে দিলে ইতিহাস

নারী টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে সেরা ১০ ছবি

নারী টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে সেরা ১০ ছবি