সাফল্য-ব্যর্থতায় ২০২৩ সালে যেমন ছিল বাংলাদেশ ক্রিকেট

স্পোর্টসমেইল২৪ স্পোর্টসমেইল২৪ প্রকাশিত: ০২:৩৭ পিএম, ০২ জানুয়ারি ২০২৪
সাফল্য-ব্যর্থতায় ২০২৩ সালে যেমন ছিল বাংলাদেশ ক্রিকেট

সাফল্য-ব্যর্থতায় মোড়ানো ২০২৩ সাল পার করলো বাংলাদেশের ক্রিকেট। শেষে ভালো করলেও বছরটিতে সাফল্যে রঙীন করার সুবর্ণ সুযোগ ছিল বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের। ওয়ানডে বিশ্বকাপে টাইগারদের ব্যর্থতা ২০২৩ সালের সবচেয়ে বড় হতাশার ছিল। সঙ্গে ছিল সাকিব আল হাসান এবং তামিম ইকবালের মধ্যে দ্বন্দ্ব নিয়ে নানা ঘটনা।

বিশ্বকাপের ভরাডুবির সাথে দেশের সবচেয়ে বড় দুই তারকা ক্রিকেটার সাকিব এবং তামিমের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেশের ক্রিকেটকে আরেকটি লজ্জাজনক অধ্যায়। বিশ্বকাপে মাত্র ২টি ম্যাচ জিততে পেরেছে টাইগাররা। তবে বড় আসরে বড় ব্যর্থতার পরও শেষ দিকে নিউজিল্যান্ডের মাঠে প্রথমবারের মতো ওয়ানডে এবং টি-টোয়েন্টি ম্যাচ জয়ের নজির গড়েছে টাইগাররা।

২০২৩ সাল কেমন ছিল বাংলাদেশ ক্রিকেটে, চলুন সংক্ষিপ্তভাবে জেনে নেওয়া যাক-

টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশ
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৩ সালে টেস্টে ফরম্যাটে বলার মতো সাফল্য পেয়েছে বাংলাদেশ। চার ম্যাচের মধ্যে তিনটিতেই জিতেছে তারা। এর মধ্যে বড় দল নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষেও জয় পেয়েছে টাইগাররা। এছাড়া আয়ারল্যান্ডকে ৭ উইকেটে হারানোর পর আফগানিস্তানকে ৫৪৬ রানের বড় ব্যবধানে জয়ের স্বাদ পেয়েছি বাংলাদেশ।

তবে মিরপুরে নিজেদের পাতানো ফাঁদে পড়ে কিউইদের কাছে ৪ উইকেটে ম্যাচ হেরে যায় টাইগাররা। সিলেটের মতো উইকেট না বানিয়ে মিরপুরে স্পিন বান্ধব ট্রাকে খেলতে নেমে বিপদে পড়ে বাংলাদেশ। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথমবারের মতো টেস্ট সিরিজ জয়ের সুযোগ নষ্ট করে স্বাগতিকরা।

ওয়ানডে গর্ব ধুলিসাৎ
২০১৫ থেকে ২০২২ পর্যন্ত ওয়ানডে ফরম্যাটে মাত্র একটি সিরিজ হেরে ঘরের মাঠকে নিজেদের দুর্গে পরিণত করেছিল বাংলাদেশ। তবে ২০২৩ সালে দুর্গটি ভেঙে চুরমার হয়েছে। ২০২৩ সালে ঘরের মাঠে ইংল্যান্ড, আফগানিস্তান এবং নিউজিল্যান্ডের কাছে সিরিজ হারের লজ্জা পেয়েছে টাইগাররা।

ধীর গতির উইকেট বানিয়েও প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে পারেনি টাইগাররা। অবশ্য আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে হোম ও অ্যাওয়ে, দু’জায়গাতেই সিরিজ জয়ের স্বাদ পেয়েছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে দুঃস্বপ্নের বিশ্বকাপ অভিযান ছিল বাংলাদেশের। তবে ওয়ানডে ফরম্যাটে শেষটা ভালো করেছে বাংলাদেশ।

সিরিজ হারলেও নিউজিল্যান্ডের মাটিতে প্রথমবারের মতো ওয়ানডে ম্যাচ জয়ের রেকর্ড গড়েছে বাংলাদেশ। হতাশাজনক বছরের শেষের দিকে প্রথম দুই ম্যাচ হেরে সিরিজ হাতছাড়া করার পর তৃতীয় ও শেষ ম্যাচে নিউজিল্যান্ডকে ৯ উইকেটে বিধ্বস্ত করে বাংলাদেশ। এতে ঘরের মাঠে নিউজিল্যান্ডের টানা ১৭ ম্যাচ অপরাজিত থাকার রেকর্ড থামিয়ে দেয় বাংলাদেশ। সব মিলিয়ে এ বছর ৩২টি ওয়ানডের মধ্যে ১১টিতে জয়, ১৮টিতে হার এবং তিনটি ম্যাচ পরিত্যক্ত হয় বাংলাদেশের।

টি-টোয়েন্টিতে খর্বশক্তির বদনাম ঘোচানো
২০২২ সালে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভরাডুবির পর সাকিব আল হাসানের চৌকস নেতৃত্বে এ ফরম্যাটে ঘুড়ে দাঁড়ায় বাংলাদেশ। ওয়ানডের মতো এ ফরম্যাটেও বাংলাদেশকে শক্তিশালী দলে পরিণত করতে বদ্ধপরিকর ছিলেন সাকিব এবং এখন পর্যন্ত নিজের কথা রাখতে পেরেছেন তিনি।

টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে বাংলাদেশ এখন আর দুর্বল দল নয়। ২০২৩ সালে মোট ১৪টি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলেছে বাংলাদেশ দল। যার মধ্যে ১০ জয়, ৩টিতে হার এবং একটি ম্যাচ পরিত্যক্ত হয়েছে। এর মধ্যে ঘরের মাঠে তিন ম্যাচের সিরিজে বর্তমান বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ করে ইতিহাসের জন্ম দিয়েছে বাংলাদেশ। এরপর আয়ারল্যান্ডকে ২-১ ব্যবধানে ও পুরনো শত্রু আফগানিস্তানকে দুই ম্যাচের সিরিজে হোয়াইটওয়াশ করে টাইগাররা।

তামিমের অবসর ও অধিনায়কত্ব নিয়ে নাটক
জুলাইয়ে আফগানিস্তানের বিপক্ষে সিরিজ চলাকালীন হঠাৎ করেই ক্রিকেট থেকে অবসরের ঘোষণা দেন তামিম ইকবাল। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপে ২৮ ঘণ্টার মধ্যে অবসরের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে নেন তিনি। পরে জানা যায়, প্রধান কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহের সাথে তামিমের সম্পর্কে ফাটল ধরেছিল।

এমনকি সাকিব আল হাসানের সাথেও সম্পর্ক ভালো যাচ্ছিলো না তামিমের। তবে ইনজুরি নিয়ে উদ্বেগ থাকায় ওয়ানডে ফরম্যাটের অধিনায়কত্ব ছাড়েন তামিম। এতে তিন ফরম্যাটেরই অধিনায়ক হয়ে যান সাকিব।

তামিম বনাম সাকিব
দেশ সেরা দুই ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান ও তামিম ইকবালের মধ্যকার অনাকাঙ্খিত ঘটনার জন্য এ বছরটি স্মরণীয় হয়ে থাকবে। বিশ্বকাপের আগে নিজের ফেসবুকে একটি ভিডিও পোস্ট করে তামিম বলেন, চারপাশের কিছু ব্যক্তির নোংরা আচরণে তিনি ক্লান্ত এবং ইনজুরি নিয়ে উদ্বেগ থাকার কারনে বিশ্বকাপে না খেলার সিদ্বান্ত নিতে বাধ্য হয়েছেন।

তার ভিডিও পোস্টের কয়েক ঘন্টা পর একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের সাথে সাক্ষাৎকারে তামিমের শিশুসুলভ আচরণের জন্য ক্ষোভ প্রকাশ করেন সাকিব। যে কারণে অনেকেরই ধারণা বিশ্বকাপের ঠিক আগে দুই তারকার বিবাদে মেগা ইভেন্টে ভরাডুবি হয় বাংলাদেশের।

এশিয়ান গেমসে ব্রোঞ্জ জয়
চীনের হাংজুতে অনুষ্ঠিত এশিয়ান গেমসে স্বর্ণ জয়ের লক্ষ্য থাকলেও ব্রোঞ্জ পেয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে বাংলাদেশকে। জাতীয় দলে খেলা বেশিরভাগ ক্রিকেটারদের নিয়ে এশিয়ান গেমসের দল সাজানো হয়েছিল। গ্রুপ পর্বে সহযোগী দেশগুলোর বিপক্ষে সব ম্যাচেই জয় পেয়েছিল তারা। তবে সেমিফাইনালের আসল পরীক্ষায় বর্তমান চ্যাম্পিয়ন ভারতের কাছে ৯ উইকেটে হেরে যায় বাংলাদেশ। পরে পাকিস্তানকে হারিয়ে ব্রোঞ্জ জিতে বাংলাদেশ।

যুবাদের হাত ধরে এশিয়ার শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট
২০২৩ সালে বাংলাদেশ ক্রিকেটের বড় সাফল্য ছিল অনূর্ধ্ব-১৯ দলের এশিয়া কাপ জয়। এ সাফল্য সিনিয়রদের ওয়ানডে বিশ্বকাপে ব্যর্থতাকে কিছুটা হলেও মুছে দিয়েছে। পাশাপাশি নারী দলের অগ্রগতিও চোখে পড়ার মত। অনূর্ধ্ব-১৯ দলের বেশ কিছু খেলোয়াড় নিজেদের প্রতিভা মেলে ধরতে পারে। বছরটিতে সাফল্যের দিক দিয়ে পুরুষ দলের চেয়ে অনেক এগিযে ছিল নারীরা।

আলো ছড়িয়েছে নারী ক্রিকেট দল
দারুণ একটি বছর পার করেছে বাংলাদেশ নারী দল। জুলাইয়ে ঘরের মাঠে তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে শক্তিশালী ভারতের সাথে ১-১এ ড্র করে নিজেদের উন্নতির ইঙ্গিত দেয় তারা। এমনকি ভারতের বিপক্ষে তিন ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজে হারলেও ১টি ম্যাচে জয় পেয়েছিল বাংলাদেশ।

এশিয়ান গেমসে ব্রোঞ্জ পদক জিতে নেয় বাংলাদেশ নারী দল। এরপর পাকিস্তানের বিপক্ষে ওয়ানডে এবং টি-টোয়েন্টি সিরিজে ২-১ ব্যবধানে জয় পায় বাংলাদেশ। তবে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে নারীদের পারফরমেন্সের অগ্রগতি ফুটে উঠে। প্রোটিয়াদের বিপক্ষে প্রথমবারের মতো টি-টোয়েন্টি ও ওয়ানডে ম্যাচ জয়ের স্বাদ পায় তারা। টি-টোয়েন্টি সিরিজ ১-১এ ড্র করলেও ২-১ ব্যবধানে ওয়ানডে সিরিজে হারে বাংলাদেশ। তারপরও নারী ক্রিকেটারদের জন্য এটি স্মরণীয় বছরই ছিল।

দুর্দান্ত পিংকি, অসাধারণ শান্ত
সাকিব আল হাসানের অনুপস্থিতিতে অধিনায়কত্বের গুরুদায়িত্ব পাওয়ার পর দারুণভাবে দলকে নেতৃত্ব দেন নাজমুল হোসেন শান্ত। আত্মবিশ্বাস ধরে রেখে পুরো বছরই দুর্দান্ত ফর্ম ছিলেন তিনি। ওয়ানডে এবং টেস্ট দুই ফরম্যাটে বাংলাদেশের পক্ষে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক ছিলেন এ বাঁ-হাতি।

টি-টোয়েন্টিতে তৃতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক ছিলেন শান্ত। টেস্টে ৪ ম্যাচে ৫৫ গড়ে তিন সেঞ্চুরিতে ৪৪০ রান করেছেন তিনি। অল্পের জন্য এ বছর ওয়ানডে ১ হাজার রানের মাইলফলক স্পর্শ করতে পারেননি ২৭ ম্যাচে ২টি সেঞ্চুরি এবং ৮টি হাফ সেঞ্চুরিতে ৯৯২ রান করা শান্ত।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রথম বাংলাদেশি নারী ক্রিকেটার হিসেবে এ বছর ভারতের বিপক্ষে তৃতীয় ও শেষ ওয়ানডেতে দারুণ সেঞ্চুরিতে ১৬০ বলে ১০৭ রানের ইনিংস খেলেন ফারজানা হক পিংকি। তার সেঞ্চুরির ইনিংস খেলা ম্যাচটি শেষ পর্যন্ত টাই হয় এবং তিন ম্যাচের সিরিজ ১-১ সমতায় শেষ করে বাংলাদেশ। তবে সেখানেই থামেননি পিংকি। প্রথম নারী ক্রিকেটার হিসেবে বিদেশের মাটিতে সেঞ্চুরির করেন তিনি। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে রেকর্ড গড়া ইনিংসে ১০২ রান করেন তিনি। প্রোটিয়াদের কাছে ৮ উইকেটের হারে পিংকির রেকর্ড গড়া সেঞ্চুরিটি বৃথা যায়।

এছাড়া প্রথম বাংলাদেশি নারী ক্রিকেটার হিসেবে আইসিসি ওয়ানডে ব্যাটিং র‌্যাংকিং তালিকায় শীর্ষ ২০-এর মধ্যে প্রবেশ করেন পিংকি। বছরের শেষ সপ্তাহে আইসিসির সর্বশেষ আপডেট অনুযায়ী ১৩তম স্থানে জায়গা করে নেন তিনি।

নতুন সেনসেশন হৃদয়-তানজিম
২০২০ সালে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ জয়ী দলের সদস্য ছিলেন ব্যাটার তাওহিদ হৃদয় এবং পেসার তানজিম হাসান সাকিব। এ বছর জাতীয় দলে সুযোগ পেয়েই নিজেদের মেলে ধরেন তারা। অবশ্য মাঝে কিছুটা খারাপ সময় গেলেও ওয়ানডেতে এ বছর ২৭ ম্যাচে ৬টি হাফ-সেঞ্চুরিতে ৭২৭ রান করেন হৃদয়। বড় দলের বিপক্ষে বাংলাদেশের কিছু জয়ে দারুণ অবদান রেখেছিলেন তিনি। ৮ টি-টোয়েন্টিতে ১৫৬ রান করেন এই ডান হাতি। দুই ফরম্যাটে বাংলাদেশের পক্ষে চতুর্থ সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক ছিলেন হৃদয়।

এছাড়া নিয়মিত না হলেও দলে সুযোগ পেলেই নিজের প্রতিভা মেলে ধরেছেন তানজিম। হতাশার এশিয়া কাপে নিজেদের শেষ ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে সান্ত্বনার জয় পায় বাংলাদেশ। সদ্যই নিউজিল্যান্ডের মাটিতে বাংলাদেশের প্রথম ওয়ানডে জয়ের নায়ক ছিলেন এ পেসার।



শেয়ার করুন :