ছেলেদের ক্রিকেটে সর্বোচ্চ সেঞ্চুরির মালিক কে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে কোনো ক্রিকেটপ্রেমিকেই গুগল করতে হবে না। সবাই বলবেন শচীন টেন্ডুলকারের নাম। যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, নারীদের ক্রিকেটে সর্বোচ্চ সেঞ্চুরির মালিক কে? এই প্রশ্নের উত্তর পেতে বেশ খানিকক্ষণ সময় অপেক্ষা করতে হবে ক্রিকেটপ্রেমীদের। আর এর উত্তর হলো, অজি ক্রিকেটার মেগ ল্যানিং!
মাত্র ১৮ বছর বয়সে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পা রাখা মেগ ল্যানিংকে অবশ্য আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে নিজের প্রথম সেঞ্চুরির দেখা পেতে শচীনের মতো দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়নি। ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় ম্যাচেই পেয়েছিলেন সেঞ্চুরির দেখা। সেই যে শুরু এখন পর্যন্ত নিজ গতিতেই এগিয়ে চলেছেন অস্ট্রেলিয়ার এই নারী ক্রিকেটার।
সিঙ্গাপুরে জন্ম নেওয়া এই নারী ক্রিকেটার ছোটো বেলাতেই ফিরে আসেন নিজ দেশ অস্ট্রেলিয়ায়। সেখানেই বিকশিত হয় তার ক্রিকেট ক্যারিয়ারের। সবাইকে অবাক করে দিয়ে ২০০৬ সালে মাত্র ১৪ বছর বয়সেই দেখা মেলে তার ক্রিকেট প্রতিভার প্রথম সাফল্য। প্রথম নারী ক্রিকেটার হিসেবে স্কুল ক্রিকেটে প্রথম একাদশের হয়ে খেলেন।
এখান থেকেই শুরু, স্কুল ক্রিকেট খেলার পাঁচ বছর পর ২০১১ সালে মাত্র ১৮ বছর বয়সে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পা রাখেন মেগ ল্যানিং। অভিষেক ম্যাচে প্রত্যাশার চাপ সামলে বড় ইনিংস খেলতে না পারলেও দ্বিতীয় ম্যাচে ঠিকই নিজের জাত চিনিয়েছিলেন ল্যানিং। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে নিজের দ্বিতীয় ম্যাচেই হাঁকান ক্যারিয়ারের প্রথম ওয়ানডে সেঞ্চুরি।
অভিষেকের আগেই অস্ট্রেলিয়া জুড়ে ল্যানিংকে নিয়ে তৈরি হয়েছিল আলোচনা। তার প্রমাণও দিয়েছিলেন দ্বিতীয় ম্যাচে। ওই ইনিংসের পর শুধু অস্ট্রেলিয়াবাসী নয়, প্রতিপক্ষও তার প্রশংসা করতে ভোলেনি।
অভিষেকে ম্যাচেই ইংল্যান্ডের বিপক্ষে মাঠে নেমেছিলেন। তার দারুণ ব্যাটিংয়ের ইংল্যান্ড অধিনায়কও প্রশংসা বাক্য শোনাতে কোনো কৃপণতা করেনি। বরং জানিয়েছিলেন, তার ভুল ভেঙেছে।
তিনি বলেন, ‘আমি তার নাম শুনেছিলাম। প্রথম ম্যাচের পর মনে হয়েছিল তাকে নিয়ে অতিরিক্ত আলোচনা হচ্ছে। তবে দ্বিতীয় ম্যাচের পর আমার ওই ভুল ভাঙে। আমি বুঝতে পারি কেন তাকে নিয়ে এতো আলোচনা করছে। আসলেই সে দারুণ একজন ব্যাটার।’
ইংলিশ ক্রিকেটের কিংবদন্তি শার্লট এডওয়ার্ডসের হাতেই ছিল নারী ক্রিকেট ব্যাটিংয়ের অধিকাংশ রেকর্ড। তার রেকর্ড ভাঙা সেই সময়ের যে কারোর পক্ষেই ছিল কিছু অসম্ভব কাজের মতো। তবে ল্যানিংয়ের অভিষেকের পর সেই ভুল ভাঙে এডওয়ার্ডসের।
তিনি বলেন, ‘ দ্বিতীয় ম্যাচের পরই আমার মনে হয়েছে, ব্যাটিংয়ের সব রেকর্ড সে নিজের করে নিবে।’
তার এই কথা আংশিক সত্যি হয়েছে। কারণ নারীদের ওয়ানডে ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সেঞ্চুরির রেকর্ড এখন ল্যানিংয়ের হাতেই। আর রেকর্ডটা নিজের করে নিয়েছেন ওই শার্লট এডওয়ার্ডসকেই সরিয়ে। যেখানে শার্লট এডওয়ার্ডস দুই দশকের ক্যারিয়ারে পেয়েছিলেন নয়টি শতকের দেখা। আর ল্যানিং এডওয়ার্ডসের সেই রেকর্ড ভেঙেছেন মাত্র ছয় বছরেই।
ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় ম্যাচে সেঞ্চুরি করা ল্যানিং অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে কম বয়সী সেঞ্চুরিয়ানও বটে। মাত্র ১৮ বছর ২৮৮ দিন বয়সে প্রথম সেঞ্চুরি হাঁকান এই ক্রিকেটার।
অভিষেকের পরের বছর আবারও সেঞ্চুরির দেখা পান ল্যানিং। এই বছরে করেন দুই সেঞ্চুরি। ভারতের বিপক্ষে ওয়ানখেড়ে স্টেডিয়ামে সেঞ্চুরির পর সিডনিতেও নিউজিল্যান্ডকে একা হাতে বিধ্বস্ত করেন তিনি। ওই ম্যাচে কিউই নারীদের বিপক্ষে মাত্র ৪৫ বলে শতক তুলে নেন।
ব্যাট হাতে নিয়মিত সাফল্য পাওয়া এই ক্রিকেটারের ক্রিকেট প্রতিভা নিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় শুরু হয়েছিল তুমুল আলোচনা। এ কারণে ২০১৪ সালে অ্যাশেজ চলাকালীন হঠাৎই ভারপ্রাপ্ত অধিনায়কের দায়িত্বভার তার কাঁধে তুলে দেয় ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া (সিএ)।
নিয়মিত অধিনায়ক জোডি ফিল্ডস ইনজুরির কারণে মাঠ ছাড়তে বাধ্য হলে ২১ বছর বয়সী ল্যানিংয়ের হাতে তুলে দেওয়া হয় অধিনায়কত্বের দায়িত্বভার। এখানেও ইতিহাস গড়েন ল্যানিং! অজিদের ইতিহাসের সবচেয়ে কম বয়সী ক্রিকেটার হিসেবে অধিনায়কত্বের দায়িত্বভার তার কাঁধে উঠে। অ্যাশেজ সাফল্যের পর তাকেই দেওয়া হয় পূর্ণাঙ্গ অধিনায়কের দায়িত্বভার।
অধিনায়কত্ব পাওয়ার বছরেই চমক দেখাতে ভুল করেননি এই ক্রিকেটার। দলকে জেতান টানা তৃতীয় টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের শিরোপা। শুধু তাই নয়, ব্যাট হাতেও ছিলেন দারুণ। এই বিশ্বকাপেই ৬৫ বলে খেলেন ১২৬ রানের ইনিংস। তখনকার সময় এটাই ছিল নারীদের টি-টোয়েন্টিতে সর্বোচ্চ রানের ইনিংস।
পরের আসরে আবারও সেঞ্চুরি দেখা পান মেগ ল্যানিং। এবার নিজের রেকর্ড ভেঙে নতুন করে গড়েন। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে খেলেন অপরাজিত ১৩৩ রানের ইনিংস। অবশ্য তার এই নতুন রেকর্ড বেশিদিন টিকেনি। এই রেকর্ডের বেশ কয়েক মাস পর তারই জাতীয় দল সতীর্থ অ্যালিসা হিলি এই রেকর্ড নিজের করে নেন।
দীর্ঘ সময় ধরে ফর্মে থেকে আলোচনায় থাকলেও মেগ ল্যানিংয়ের ছিল না আন্তর্জাতিক কোনো স্বীকৃতি। ২০১৫ সালে প্রথমবারের মতো সেরা নারী ক্রিকেটারের স্বীকৃতি প্রদান করে ক্রিকেটের বাইবেল খ্যাত ‘উইজডেন’। আর অভিষেক বছরেই এই স্বীকৃতি নিজের করে নেন অজি অধিনায়ক মেগ ল্যানিং।
এই স্বীকৃতিই যেন তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। উইজডেনের বর্ষসেরা নির্বাচিত হওয়ার পর নিজেকে হারিয়ে খুঁজছিলেন মেগ ল্যানিং।
শুধু তাই নয় তার অধিনায়কত্বে ২০১৬ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের শিরোপাও হাতছাড়া করে অস্ট্রেলিয়া। এছাড়াও ২০১৭ সালে ওয়ানডে বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল থেকেও নক আউট হয় অজি নারীরা। হারমানপ্রীত কাউরের সেঞ্চুরিতে সেবার অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে বিশ্বকাপ ফাইনাল নিশ্চিত করে ভারত। এই দুই বিশ্বকাপে আবার নিজের সেরা ছন্দে ছিলেন না মেগ ল্যানিং। আর তখনই হয়তো দল থেকে বাদ পড়তে পারতেন। তবে ইনজুরির কারণে তাকে মাঠের বাইরে ছিটকে যেতে হয়।
কাঁধের ইনজুরির কারণে প্রায় দেড় বছর জাতীয় দলের বাইরে ছিলেন এই ক্রিকেটার। খেলতে পারেননি ২০১৭-১৮ মৌসুমের অ্যাশেজ।
ইনজুরি থেকে দলে ফিরে আবারও সেই চেনারুপে দেখা দেন ল্যানিং। তার ব্যাটে ভর করেই আবারও বিশ্ব শিরোপার স্বাদ পায় অস্ট্রেলিয়া। ২০২০ নারী টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালে ভারতকে হারিয়ে শিরোপা জিতে নেয় মেগ ল্যানিংয়ের অস্ট্রেলিয়া। তাই তো তার উপরই অস্ট্রেলিয়া নারী দলের অধিনায়কত্বের দায়িত্ব ভার এখনও রয়েছে।
ক্যারিয়ারের প্রথম ম্যাচে থেকেই ব্যাট হাতে বোলারদের শাসন করা মেগ ল্যামিং কিন্তু এখনও হারিয়ে যাননি। সেই শুরুর ধাঁচেই এখনও ব্যাটিং করে যাচ্ছেন। শার্লট এডওয়ার্ডসকে ছাপিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন নারীদের ওয়ানডেতে সর্বোচ্চ সেঞ্চুরির মালিক হিসেবে। আর সংখ্যাটাকে তুলে এনেছেন ১৫-তে। সেঞ্চুরি সংখ্যা যে আরও বাড়বে, তার ব্যাটের ধারে তা নিশ্চিত করেই বলা যায়।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অস্ট্রেলিয়ার হয়ে ৬ টেস্ট, ৯৭ ওয়ানডে এবং ১১৭ টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলেছেন মেগ ল্যানিং। এ সময় তিন ফরম্যাটেই তার ব্যাট থেকে এসেছে ৭ হাজার ৭৫৯ রান। করেছেন একে ১৭ সেঞ্চুরি। যদিও ক্রিকেটের রাজকীয় ফরম্যাট টেস্টে এখনও শতকের দেখা পাননি। তবে তা পেতেও যে তাকে বেগ পেতে হবে না তা এক রকম নিশ্চিত করেই বলা যায়।
স্পোর্টসমেইল২৪/পিপিআর