এবি ডি ভিলিয়ার্স : বাইশগজের ‘দুঃখী রাজপুত্র’

আরিফুল হক বিজয় আরিফুল হক বিজয় প্রকাশিত: ০৫:৩২ পিএম, ৩১ জানুয়ারি ২০২২
এবি ডি ভিলিয়ার্স : বাইশগজের ‘দুঃখী রাজপুত্র’

বাইশগজ নামক এক বইয়ের প্রতিটা অধ্যায়ের সমন্বিত রূপ হলো ক্রিকেট ব্যাকরণ। ব্যাটের আলতো ছোঁয়ায় প্রতিটা বলকে বিভিন্ন অঞ্চল দিয়ে সীমানা ছোঁয়ানো কিংবা গ্যালারীতে আছড়ে ফেলা, সবই সম্ভব হয় কেবল ক্রিকেট ব্যাকরণের শুদ্ধ প্রয়োগে। ব্যাট নামক তুলির আচড়ে ক্রিকেট ব্যাকরণের শুদ্ধ প্রয়োগে ছয় আউন্সের চর্মগোলকটা সীমানার দিকে গড়িয়ে যাচ্ছে, এটা পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরতম দৃশ্যের একটি।

আবার এই বাইশগজে, এই ব্যাট বলের খেলায় এমন কিছু খেলোয়াড়ের আগমন ঘটেছে। যারা ক্রিকেটটাকে পরিণত করেছেন দর্শকের মনের খোরাকে। ধরাবাঁধা নেই, নিত্য নতুন বিস্ময়কর শটের পসরা সাজিয়ে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে চলছেন ক্রিকেট ব্যাকরণকে। ক্রিকেটের অভিধানে তাদের একটাই পরিচয়, 'ব্যাটিং বিস্ময়'!

বোলিং প্রান্ত থেকে দৌঁড়ে আসছেন অজি গতি তারকা মিচেল স্টার্ক। অপরপ্রান্তে ব্যাট হাতে স্থির হয়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে জ্বলজ্বলে চোখে গভীর দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছেন ব্যাটার। একটা লাফ দিয়ে হাত থেকে প্রচন্ড গতির আগুনের গোলাটি ছুঁড়ে দিলেন স্টার্ক। গুডলেংথের বলটা ধেঁয়ে যাচ্ছে স্ট্যাম্প বরাবর। কিছুটা এগিয়ে আসলেন ব্যাটার। জায়গা করে হাঁটু গেড়ে নিখুঁত টাইমিংয়ে কব্জির মোচড়ের সাথে ঘুরিয়ে দিলেন ব্যাটটাও।

sportsmail24

বল গিয়ে উড়ে পড়লো সীমানার কাছাকাছি। এরপর দ্রুতই গড়িয়ে ছুঁয়ে ফেললো সীমানা এবং চার। বিস্ময়! অথচ বলটা আঘাত করার কথা ছিলো স্ট্যাম্পে কিংবা বেরিয়ে গিয়ে জমা হবার কথা ছিলো কিপারের গ্লাভসে। কিন্তু সেই সুযোগটা দিলেন না উইলো হাতে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা। কারন তিনি ভিলিয়ার্স; আব্রাহাম বেঞ্জামিন ডি ভিলিয়ার্স। ভক্তদের কাছে যিনি 'মিস্টার ৩৬০ ডিগ্রী'!

অভিষেকের পর থেকেই ব্যাট হাতে নিজেকে প্রমাণ করতে শুরু করেন এবি। দিন যত গড়িয়েছে ততই হয়ে উঠেছেন ভয়ংকর। ক্রিকেটের তিন সংস্করণের কোনোটাতেই নামের পাশে হাজার দশেক রান হয়তো শোভা পায়নি কিন্তু যা করেছেন সেগুলোই তাকে মনে রাখার মতো যথেষ্ট। অনেক ব্যাটসম্যান আছেন যারা ক্ল্যসিক ব্যাটিং করে রানের ফোয়ারা ছুটিয়ে দেন কিংবা একটা নির্দিষ্ট গন্ডির মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ করে একই ধাচে রান তুলতে থাকেন। ঠিক এই জায়গাটাতেই ডি ভিলিয়ার্স অন্যদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।

ভিলিয়ার্সের ক্রিকেট অভিধানে 'ক্ল্যাসিক' নামক কোনো শব্দ নেই কিংবা নেই নির্দিষ্ট কোনো গন্ডি, আছে কেবল ধ্বংসাত্মক উপমা। যে উপমার উপর ভর করেই তার এ পর্যন্ত আসা। ক্ল্যাসিক ব্যাটসম্যানরা নিজের জাত চেনান ক্রিকেটের ব্যাকরণ মেনে ক্লাস দেখিয়ে। ডি ভিলিয়ার্স সেই ব্যাকরণকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে সম্পূর্ন নিজের ধাচে খেলে হয়ে উঠতেন বিধ্বংসী, বইয়ে দিতেন টর্নেডো। তার এই ধ্বংসাত্মক রূপই তাকে অন্যদের থেকে আলাদা করে রেখেছে। ব্যাটিংটা তিনি পরিণত করেছিলেন স্রেফ বিস্ময়ে!

sportsmail24

ব্যাটিংয়ের সবচেয়ে নিঁখুত সূত্রটা হলো, কাঁধের পজিশন ঠিক রেখে এক পা সামনে এগিয়ে ব্যাট দিয়ে সজোরে আঘাত করে বলকে মাঠ ছাড়া করা। কখনো বা কব্জির শৈল্পিক মোচড়ের দৃশ্য! হ্যাঁ, ক্রিকেট বলতে এই সূত্রগুলোই ছিল, তবে সেটা ডি ভিলিয়ার্স নামক এক ভিনগ্রহের ক্রিকেটার আসার আগ পর্যন্ত।

ডি ভিলিয়ার্স আসলেন এবং ক্রিকেট বিশ্বকে জানিয়ে দিলেন ক্রিকেট জিনিসটা শুয়ে, বসে কিংবা শরীরটাকে ঘুরিয়ে এক পায়ে ভর দিয়েও খেলা যায়। শুধু খেলাই যায় না, বলটাকে আকাশে ভাসিয়ে সবুজের গালিচা পার করে অনায়াসে গ্যালারী কিংবা মাঠের বাইরেও পাঠানো যায়। মোট কথা, ক্রিকেটের ব্যাকরণটাই বদলে দিয়েছেন এবি। তাকে ভিনগ্রহের ক্রিকেটার বলাটা বোধহয় ভুল নয়। হোক না রক্তে মাংসে গড়া এক মানব।

নিজের এই আলাদা ধাঁচের ব্যাটিং দিয়ে পৃথিবীর সব প্রান্তই সমানভাবে মাতিয়েছেন ডি ভিলিয়ার্স? তার বিস্ফোরক ব্যাটিংয়ের স্বাক্ষী হয়েছে বিশ্ব ক্রিকেটের অসংখ্য তীর্থভূমি। কাউন্টি, বিগব্যাশ, আইপিএল, বিপিএল, পিএসএল – কোনো টুর্নামেন্টের দর্শকই তার দৃষ্টিনন্দন উইলোবাজি থেকে বঞ্চিত হননি।

sportsmail24

ভিলিয়ার্সের আরেকটা গুণ হলো, ব্যাটিং অর্ডারের সব পজিশনেই স্বাচ্ছন্দ্যে ব্যাটিং করতে পারা। ব্যাট হাতে ওপেনিং থেকে শুরু করে ফিনিশার- সব স্থানেই সমান পারদর্শিতা দেখিয়েছেন তিনি। খেলেছেন অনবদ্য সব ইনিংস। ক্রিকেটের তিন সংস্করণ মিলিয়ে ৪২০ টা ম্যাচ খেলেছেন দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে, ঝুলিতে আছে মোট ৪৭টি শতকের ইনিংস। ব্যাটিং গড় টেস্ট এবং একদিনের ক্রিকেটে যথাক্রমে ৫০.৬৬ এবং ৫৩.৫০!

ক্রিকেটের ক্ষুদ্র সংস্করণে কোনো শতক না থাকলেও আছে ১০ টি অর্ধশতক। উইকেটকিপিং গ্লাভস হাতেও ছিলেন সমান সফল। কিপিং-এ দেশের হয়ে স্ট্যাম্পিং করেছেন ১৭ বার, আর গ্লাভস সহ কিংবা গ্লাভস ছাড়াই লুফে নিয়েছেন ৪৬৩ টি ক্যাচ। ঝুলিতে আছে আন্তর্জাতিক উইকেটও টেস্টে দুইটি এবং ওডিআইতে ৭টি, সব মিলিয়ে ৯টি আন্তর্জাতিক উইকেট শিকার করেছেন এবি ডি ভিলিয়ার্স।

২০১৮ সালের ২৩ মে! ক্রিকেট পাড়ায় গুনগুন করতে লাগলো একটা গুঞ্জন। এক সময় সেটা রূপ নিলো বিস্ফোরক সংবাদে। ক্রিকেটকে বিদায় জানাচ্ছেন প্রোটিয়া অলরাউন্ডার এবি ডি ভিলিয়ার্স। বিস্ময়কর খবর বটে বৈকি! বয়সটা আর কত হলো? এক দশকেরও বেশি সময় ধরে গোটা ক্রিকেট জগতকে সুস্থ বিনোদনে মাতিয়ে রাখা মানুষটার এ কেমন সিদ্ধান্ত! যে ধারাবাহিকতার মধ্যে ছিলেন, মাতিয়ে রাখতে পারতেন আরও অনেকটা সময়।

sportsmail24

হঠাৎ করেই অভিমানী রাজপুত্রের মতো সকল প্রকার আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে নিজেকে কেন গুটিয়ে নেয়া? এক টুইটার বার্তায় জবাবটাও দিয়েছিলেন সময়ের সেরা এই ব্যাটার, ‘বড্ড ক্লান্ত আমি। সত্যি বলছি, অনেক ক্লান্ত আমি। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি সরে দাঁড়ানোর। সাউথ আফ্রিকা ক্রিকেট বোর্ডকে ধন্যবাদ সবসময় আমার উপর ভরসা রাখায়। ধন্যবাদ জানাই ক্রিকেটপ্রেমীদেরকেও। যারা সবসময় যারা সাপোর্ট করেছেন, ভালোবেসে পাশে ছিলেন।’

এবি ডি ভিলিয়ার্সের অর্জনের ঝুলিটা নেহাত কম ভারী নয়। অর্জনের ঝুলিতে যেমন পুরেছেন অসংখ্য পুরষ্কার, তেমনি রেকর্ডও। একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে দ্রুততম অর্ধ-শতক (১৬ বলে), শতক (৩১ বলে) এবং দেড়শত (৬৪ বলে) করার রেকর্ডটাও এখন অব্দি তার দখলে। ১৬২ রানের সেই টর্নেডো ইনিংস খেলেছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে।

তার ঝুলিতেই আছে দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে টেস্ট ক্রিকেটে দ্রুততম শতক এবং টি-টোয়েন্টিতে অর্ধশত করার রেকর্ড। আইসিসি ওডিআই প্লেয়ার অব দা ইয়ার জিতেছেন তিন বার যথাক্রমে ২০১০, ২০১৪ এবং ২০১৫ সালে। অর্জনের খাতাটা তাই বেশ ভারী!

sportsmail24

আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ক্যারিয়ারে এত এত প্রাপ্তির মাঝেও এবি ডি ভিলিয়ার্সের বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারের একমাত্র অপ্রাপ্তি তাকে আক্ষেপের সাগরে নিমজ্জিত করে ফেলে। যেটা তিনি নিজেও স্বীকার করেছেন। কেবল একটা জিনিসই অর্জন করতে পারেননি। তা হলো, বিশ্বমঞ্চে দক্ষিণ আফ্রিকাকে বড় কোন ট্রফি জেতাতে পারা।

নিয়তির লিখনে ক্রিকেট বিধাতা চাননি বলেই হয়তো ছোঁয়া হয়নি সোনালী ট্রফিটা। তবে তার মতো একজন ক্রিকেটারের হাতে স্থান না পাওয়াটা সম্ভবত বিশ্বকাপ ট্রফিটারই দুর্ভাগ্য। কিন্তু বাস্তবে? চোখ-ধাঁধানো এক ক্যারিয়ার শেষেও ভিলিয়ার্স হয়ে রইলেন ট্র্যাজিক হিরো, বাইশগজের 'দুঃখী রাজপুত্র'!

স্পোর্টসমেইল২৪/এএইচবি

[আমরা এখন sportsmail.com.bd ঠিকানাতেও। খেলাধুলার সর্বশেষ সংবাদ পড়তে ইনস্টল করুন আমাদের অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল অ্যাপস ]


শেয়ার করুন :


আরও পড়ুন

শেন বন্ড : অকালে হারানো তাসমান সাগরপাড়ের গতিদানব

শেন বন্ড : অকালে হারানো তাসমান সাগরপাড়ের গতিদানব

কুসংস্কার ও পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই করা প্রথম নারী রেফারির গল্প

কুসংস্কার ও পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই করা প্রথম নারী রেফারির গল্প

রি-ক্রিয়েটিভো : স্প্যানিশ ফুটবলের পতাকাবাহক

রি-ক্রিয়েটিভো : স্প্যানিশ ফুটবলের পতাকাবাহক

প্রতিভার নিদারুণ অপচয় এক গুরাভ

প্রতিভার নিদারুণ অপচয় এক গুরাভ