ফুটবল মাঠে স্বাধীনতার সংগ্রাম

পার্থ প্রতীম রায় পার্থ প্রতীম রায় প্রকাশিত: ০১:৪০ পিএম, ২৬ মার্চ ২০২২
ফুটবল মাঠে স্বাধীনতার সংগ্রাম

বলা হয় প্রতিবাদের সবচেয়ে বড় মঞ্চ হতে পারে খেলার মাঠ!  প্রতিবাদের মঞ্চ হিসেবে অন্য যে কোনো খেলার চেয়ে এক কদম এগিয়ে থাকবে ফুটবল। পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা যে ফুটবল। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা সংগ্রামে কোনো দিক থেকেই পিছিয়ে ছিলেন না আমাদের ফুটবলাররা। ফুটবলের সবুজ গালিচাকেই বানিয়েছিলেন রণক্ষেত্র! ফুটবল খেলেই স্বাধীনতার পক্ষে তৈরি করেছেন জন সমর্থন। রণাঙ্গনের যোদ্ধাদের সাথে সমানতালে উচ্চারিত হয় তাদের নামও। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের ফুটবলাররাও আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের নায়ক।

ফুটবলারদের হাতে ছিল না অস্ত্র। কিন্ত মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পায়ের ফুটবলটাই হয়ে উঠেছিল অস্ত্রের মতো ভয়ংকর। ওই চর্ম গোলকটাই হয়ে উঠেছিল প্রতিবাদের ভাষা। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল জুড়ে ফুটবল খেলে সংগ্রহ করেছিলেন অর্থ সাহায্য। গড়ে তুলেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের জনমত। স্বাধীনতার জন্য ভিনদেশের মাটিতে প্রীতি ম্যাচ খেলে জনমত গড়া, এ তো ক্রীড়া বিশ্বের এক বিরল ঘটনা।

এপ্রিলে মুজিবনগর সরকার গঠিত হলেও শুরুতে জনমত তৈরির জন্য ছিল শুধু কুটনৈতিক তৎপরতা। সাধারণ মানুষের মধ্যে স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে জনমত তৈরি করতে গঠন করা হয় একটি ফুটবল দল। যা কিনা স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল নামে পরিচিতি পায়।

যুদ্ধ শুরুর প্রায় তিন মাস পর ১৯৭১ সালের জুনে গঠন করা হয় স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল। মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল গঠন করার কথা জানা যায়। সে চিঠিতে সাড়া দিয়ে মুজিবনগরে ফুটবল দলে যোগ দেন- প্রতাপ শঙ্কর হাজরা, শেখ আশরাফ আলী, সাইদুর রহমান প্যাটেল, আলী ইমামসহ আরও কয়েক জন।

sportsmail24

স্বাধীনতার সময় বাংলার মানুষের প্রিয় গণমাধ্যম হয়ে উঠেছিল আকাশবাণী রেডিও (রেডিও কলকাতা)। সেখানে দেওয়া এক বার্তায় মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে আসা ফুটবলারদের মুজিবনগরে রিপোর্ট করতে বলা হয়। সেখান থেকেই গঠন করা হয় স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল। দলে সুযোগ পান ৩১ ফুটবলার (মতান্তরে ৩৫ ফুটবলার)।

দল গঠন করলেই তো আর হবে না, আয়োজন করতে হবে ম্যাচ। আর ম্যাচ আয়োজন করতে হলে দরকার যোগ্য সংগঠকদের একটি প্রতিষ্ঠান। এ কারণেই কলকাতায় গঠিত হয় ‘বাংলাদেশ ক্রীড়া সমিতি’। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের সব ম্যাচের আয়োজক ছিল এই ‘বাংলাদেশ ক্রীড়া সমিতি’। স্বাধীন-সার্বোভৌম বাংলাদেশের অনেকেই হয়তো এ প্রতিষ্ঠানের নামই জানেন না।

বহু প্রতীক্ষার পর শেষ পর্যন্ত মাঠে নামে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল। প্রথম ম্যাচে প্রতিপক্ষ হিসেবে ছিল নদীয়া ক্রীড়া সমিতি একাদশ। এ ম্যাচের উদ্দেশে ২৩ জুলাই মুজিবনগর থেকে নদীয়ায় পৌঁছে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল। অবশ্য এরপর কলকাতায় তাদের জন্য আবাসনের ব্যবস্থা হয়ে যায়। সেখানেই থেকে অনুশীলন এবং ভারতজুড়ে ম্যাচ খেলেছিল স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল।

নদীয়ায় পৌঁছানোর দুই দিন পর কৃষ্ণনগর স্টেডিয়ামে নদীয়া ক্রীড়া সমিতির বিপক্ষে ২-২ গোলে ম্যাচ ড্র করে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল। দলের হয়ে প্রথম গোল করেন শাহাজাহান।

এ ম্যাচেই প্রথমবারের মতো খেলার মাঠে উত্তোলিত হয় স্বাধীন বাংলার পতাকা। ভিনদেশের পতাকা উত্তোলনের কারণে শাস্তির মুখে পড়েন কৃষ্ণনগরের জেলা প্রশাসক। তবুও থেমে থাকেনি স্বাধীন বাংলা জাতীয় দলের অগ্রযাত্রা। বহু বাধা বিপত্তি পেরিয়ে এগিয়ে গিয়েছে তরুণ সালাউদ্দিন-নওশেরুজ্জামানরা।

স্বাধীন বাংলার পতাকাতলে ভারতের বিভিন্ন শহরে মোট ১৭ টি প্রদর্শনী ম্যাচ খেলেন ফুটবলাররা। শুধু পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে নয় বিহার, বেনারস, মুম্বাইসহ ভারতের বিভিন্ন শহরে খেলেছেন একের পর এক ম্যাচ।

sportsmail24

স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন জাকারিয়া পিন্টু এবং সহ-অধিনায়কের দায়িত্বে ছিলেন প্রতাপ শঙ্কর হাজরা। স্বাধীনতার পর দীর্ঘদিন জানা যায় নি ঠিক কতটি ম্যাচ খেলেছিল স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল। পরে অবশ্য এ বিষয়ক কিছুটা তথ্য পাওয়া যায়।

১৯৮০ সালে জাকারিয়ার পিন্টুর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ১৪ ম্যাচ খেলেছিল স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল। এ সময় স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল ৯ ম্যাচে জয় পেয়েছিল, হেরেছিল মাত্র ৩ ম্যাচে আর ড্র ২ ম্যাচে। এরপরে দলের সহ-অধিনায়ক প্রতাপ শঙ্কর হাজরা আরও ৩ ম্যাচের ফলাফল সম্পর্কে জানান। সেই তিন ম্যাচেই জিতেছিল স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল।

স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের অবস্থান ছিল কলকাতা। কলকাতার পার্ক স্ট্রিটে কোকাকোলা ভবন নামে পরিচিত ‘করনানি এস্টেট বিল্ডিং’- এ আবাসিক ক্যাম্প করেছিল স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল। আর অনুশীলন করতো পার্ক সার্কাস ময়দানে।

একটু আগেই ‘বাংলাদেশ ক্রীড়া সমিতি’ র সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়েছে। ১৯৭১ সালের ২৩ জুন গঠিত হয় এই বাংলাদেশ ক্রীড়া সমিতি। সে সময় ‘বাংলাদেশ ক্রীড়া সমিতি’-কে স্বাগত জানিয়ে কলকাতা থেকে প্রকাশিত আনন্দবাজার পত্রিকা লিখেছিল ‘আরেক মুজিব বাহিনী’।

বরাবরই বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান ছিল ভারতের। সে কারণেই মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বাংলাদেশের শরণার্থী কিংবা রাজনৈতিক নেতারা ভারতের বেশ স্বাচ্ছন্দ্যেই ছিলেন। এরই অংশ হিসেবে ভারতে নিরাপদ ছিলেন স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের খেলোয়াড় ও কর্মকর্তারা।

কিন্তু ভারতের মাটিতে তাদেরকে হামলার শিকার হতে হয়। ১৯৭১ সালের অক্টোবরে বিহারে ম্যাচ খেলতে যাওয়ার সময় হামলার শিকার হয় স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল। সে সময় ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ বলে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের উপর হামলা করা হয়।

একই মাসে অক্টোবরে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের বিপক্ষে মাঠে ভারতের কিংবদন্তি ফুটবল দল। ভারতের কিংবদন্তি ফুটবলার চুনি গোস্বামীর নেতৃত্বে গোষ্ঠ পাল একাদশ নামে খেলেছিল তারা। যদিও সে ম্যাচে গোষ্ঠ পাল একাদশের বিপক্ষে জিততে পারেনি স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল। ম্যাচ হেরেছিল ৪-২ গোলে।

sportsmail24

স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের ম্যাচের ফলাফল কখনই মূখ্য ভূমিকা রাখেনি। বরং এই ম্যাচগুলোর মাধ্যমে তৈরি হওয়া জনমত আর মুক্তিযুদ্ধের তহবিল গঠন করাটাই ছিল মূল উদ্দেশ্য।সে উদ্দেশ্যে সফল ছিল স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের তহবিলে জাকারিয়া পিন্টু-প্রতাপ শঙ্কর হাজরাদের মাধ্যমে যুক্ত হয়েছিল ১৬ লাখ ৩৩ হাজার টাকা। স্বাধীন বাংলার পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন ভারতের কিংবদন্তি ফুটবলাররা। ভারতের কিংবদন্তি ফুটবলার গোষ্ঠ পাল সেদিন বলেছিলেন, ‘আমরাও বাংলার বন্ধু। কেবল মানুষ হয়েছি এই বাংলায়।’

মাঠের খেলোয়াড়দের না হয় জানা যায়, মাঠের বাইরের নেতাদের সম্পর্কে কতটুকু জানি আমরা? স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের ফুটবলারদের সম্পর্কে জানা গেলেও কোচ কিংবা ম্যানেজারের নাম জানা অনেকটাই কঠিন। জানা যায়, স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের কোচ হিসেবে কাজ করেছিলেন ননী বসাক আর ম্যানেজারের দায়িত্বে ছিলেন তানভীর মাজহার তান্না। ম্যানেজার তান্না অবশ্য পরে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সাথেও যুক্ত হয়েছিলেন।

বহির্বিশ্বে খেলার মাধ্যমে স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গড়ে তোলার এক কঠিন কাজে নিয়োজিত ছিলেন এই ফুটবলাররা। শত বাঁধা বিপত্তি পেরিয়ে রণাঙ্গনের সৈনিকদের পক্ষে তৈরি করেছিলেন হাজারো জনমত।

স্পোর্টসমেইল২৪/পিপিআর


শেয়ার করুন :


আরও পড়ুন

আপন গতিতে নারীদের ‘সেরা সেঞ্চুরিয়ান’ মেগ ল্যানিং

আপন গতিতে নারীদের ‘সেরা সেঞ্চুরিয়ান’ মেগ ল্যানিং

মিথুন মানস : আক্ষেপ আর অপেক্ষা

মিথুন মানস : আক্ষেপ আর অপেক্ষা

নিলাম ঘরের ত্রাণকর্তা চারু শর্মা

নিলাম ঘরের ত্রাণকর্তা চারু শর্মা

শচীন ও দূর্ভাগা অমল: প্রতিভাবান হয়েও অর্জনের পার্থক্য আকাশ-পাতাল

শচীন ও দূর্ভাগা অমল: প্রতিভাবান হয়েও অর্জনের পার্থক্য আকাশ-পাতাল