লোলিত মোদি ও আইপিএলের জন্ম

পার্থ প্রতীম রায় পার্থ প্রতীম রায় প্রকাশিত: ০৫:২৪ পিএম, ২৬ মার্চ ২০২২
লোলিত মোদি ও আইপিএলের জন্ম

ক্রিকেটে বিশুদ্ধতার প্রতীক হিসেবে পরিচিত টেস্ট ক্রিকেট! তবে বিশুদ্ধ এবং প্রাচীনতম সংস্করণ হওয়ার পরও বিশ্বজুড়ে ক্রিকেটকে জনপ্রিয়তা এনে দিতে পারেনি টেস্ট। ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা না পাওয়ার এই দূর্নাম ঘুচিয়েছে নবীনতম সংস্করণ টি-টোয়েন্টি। টি-টোয়েন্টির মাধ্যমে ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধিতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা সম্ভবত ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের (আইপিএল)। 

বিশ্ব ক্রিকেটে ফ্রাঞ্চাইজি লিগের জন্ম আর অর্থের ঝনঝনানি দু’টোই তৈরি করেছে আইপিএল। গ্ল্যামার, প্রতিদ্বন্দ্বিতা কিংবা সুবিধা সবকিছুতেই ক্রিকেটের অন্যসব টুর্নামেন্টের থেকে ঢের এগিয়ে বিশ্বের সর্বপ্রথম এই ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেট লিগ।

দক্ষিণ আফ্রিকায় ২০০৭ সালে প্রথমবারে মতো আয়োজিত হয় টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। বিশ্বকাপের এই উন্মাদনাই বিশ্বজুড়ে বাড়িয়েছে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা। বিশ্বকাপ আয়োজনের আগের বছরই নিউজিল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়ার মধ্যকার ম্যাচ দিয়ে টি-টোয়েন্টি যুগে প্রবেশ করে ক্রিকেট বিশ্ব। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের প্রতি লোকজনের এই আগ্রহকে কাজে লাগিয়ে ফ্রাঞ্চাইজি ভিত্তিক টুর্নামেন্ট আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেয় ভারতীয় প্রতিষ্ঠান ‘জি এন্টারটেইনমেন্ট’। নাম ছিল ইন্ডিয়ান ক্রিকেট লিগ (আইসিএল)।

আইসিএলকে বলা যায় ছিল ১৯৭৭-৭৮ সালে চালু হওয়া গ্যারি প্যাকার বিদ্রোহী সিরিজের আধুনিক সংস্করণ। আইসিএলে ছিল অবসরে যাওয়া নামকরা বিদেশি এবং ভারতীয় ক্রিকেটাররা। জাতীয় দলের হয়ে খেলছেন এমন নামকরা বিদেশি ক্রিকেটারদের রাজি করাতে পারেনি আয়োজক কর্তৃপক্ষ। কারণ টুর্নামেন্ট মাঠে গড়ানোর আগেই নিষিদ্ধ ঘোষণার উদ্যোগ নেওয়া হয়। নামকরা বিদেশি ক্রিকেটারদের নিয়ে আসতে না পারলেও একটি ভিন্নতার তৈরি করেছিল আইসিএল কর্তৃপক্ষ। তা হলো শহর ভিত্তিক দল তৈরি করা। এতেই নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও ক্রিকেট সমর্থকদের নজর কাড়ে টুর্নামেন্টটি।

আইসিএলের তুমুল জনপ্রিয়তা দেখে টি-টোয়েন্টি সংস্করণে একটি লিগ চালুর ব্যাপারে কথা-বার্তা শুরু করে ভারতীয় ক্রিকেটের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিসিসিআই। আর এই দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন বিসিসিআইয়ের তখনকার সময়ের সহ-সভাপতি লোলিত মোদি।

sportsmail24

এইবার একটু পিছন ফেরা যাক, শহরভিত্তিক দল নিয়ে বেশ আগেই একটি ক্রিকেট টুর্নামেন্ট আয়োজনের পরিকল্পনা করছিলেন বিসিসিআইয়ের সাবেক সহ-সভাপতি লোলিত মোদি। মূলত, যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশুনা করতে গিয়ে ফ্রাঞ্চাইজিভিত্তিক খেলার সাথে পরিচিত হন লোলিত মোদি। তখনই ফ্রাঞ্চাইজি ভিত্তিক টূর্নামেন্ট আয়োজনের পরিকল্পনা আটেন এই ব্যবসায়ী। এই কারণে সব বিবেচনাতেই লোলিত মোদির হাতেই দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয়।

শুধু পরিকল্পনা করেই নয়, একবার উদ্যোগও নিয়েছিলেন লোলিত মোদি। ১৯৯৬ সালে ভারতীয় ক্রিকেট দলের ম্যাচ দেখানোর জন্য বিসিসিআইয়ের ব্রডকাস্ট পার্টনার হয়েছিল ইএসপিএন। যার মালিকানায় ছিল লোলিত মোদির প্রতিষ্ঠান ‘মোদি ইন্টারটেইনমেন্ট লিমিটেড।’

এই সুবিধা কাজে লাগিয়ে ১৯৯৬ সালে ‘ইন্ডিয়ান ক্রিকেট লিগ (আইসিএল) লিমিটেড’ নামে একটি কোম্পানির অনুমোদন নিয়ে নেন লোলিত মোদি। একই সময়ে বিসিসিআইয়ের কাছ থেকে আইসিএল নামক একটি টুর্নামেন্ট আয়োজনের অনুমতিও নেন। এমনকি সে সময় টুর্নামেন্টটিতে বিসিসিআই জাতীয় দলের ক্রিকেটারদের অংশ নেওয়ার বিষয়ে নিশ্চয়তাও দিয়েছিল। তবে শেষ পর্যন্ত নানাদিক বিবেচনায় এই উদ্যোগ দেখেনি আলোর মুখ।

ব্যর্থ হলেও সেই ফ্রাঞ্চাইজি টূর্নামেন্ট আয়োজনের কথা কখনই ভোলেননি লোলিত মোদি। বরং অপেক্ষায় ছিলেন সুযোগের। আর সেই সুযোগ কাজে লাগিয়েই তৈরি করেছেন বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় ক্রিকেট লিগ আইপিএল।

sportsmail24

২০০৭ সালে আইসিএল আয়োজন করা হলে ‘জি ইন্টারটেইনমেন্ট’-র বিরুদ্ধে আদালতে যাওয়ার সুযোগ ছিল লোলিত মোদির সামনে। কারণ আরও ১১ বছর আগে ১৯৯৬ সালে আইসিএল নামক একটি টুর্নামেন্টের অনুমতি নিয়ে রেখেছিলেন তিনি। এই সুবিধা নিয়ে আইনি লড়াইয়েও নামতে পারতেন। তবে তিনি ওই পথে হাঁটেননি।

আইসিএল শুরুর দুই বছর আগে অর্থাৎ ২০০৫ সালে বিসিসিআইয়ের সহ-সভাপতি পদে বসেন ললিত মোদি। সেই সুবিধা কাজে লাগিয়ে ২০০৭ সালে আইসিএলকে নিষিদ্ধ করেন। আর জানিয়ে দেন আইসিএলের সাথে সম্পৃক্ত কেউ ক্রিকেটের সাথে যুক্ত হতে পারবেন না। যদিও পরে এই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়। আর বিসিসিআইয়ের দেওয়া এই ধাক্কাতেই অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয় আইসিএলের বড় হওয়ার স্বপ্ন।

আইসিএল কে নিষিদ্ধ করার পরই আইপিএল আয়োজন করতে মরিয়া হয়ে উঠেন লোলিত মোদি। কিভাবে টুর্নামেন্ট আয়োজন করা হবে, কিভাবে আকর্ষণীয় করে তোলা যায় এই বিষয়টি নিয়ে বেশ চিন্তিত ছিলেন লোলিত মোদি। তবে এই চিন্তা দূর করে দেয় যুক্তরাজ্য ভিত্তিক ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠান আইএমজি।

যুক্তরাজ্যে আইপিএল মাঠে নামানোর বিষয়ে আইএমজির সাথে বৈঠক করেন লোলিত মোদি। পরে আইপিএল মাঠে গড়াবে কিনা সেই নিশ্চয়তা না থাকলেও টুর্নামেন্টের ইভেন্ট স্বত্ব ৪০ মিলিয়ন ডলারে আইএমজি র কাছে বিক্রি করে দেন লোলিত মোদি।

এরপরেই আইপিএলকে একরকম ব্যক্তিগত সম্পত্তি বানিয়ে ফেলেন লোলিত মোদি। তখনকার সময়ে বিসিসিআইয়ের সভাপতি শারদ পাওয়ারের কাছে আইপিএল আয়োজন বাবদ ২৫ মিলিয়ন ডলার নেন লোলিত মোদি। এছাড়াও বিসিসিআইকে আইপিএল থেকে দূরে রাখতে আলাদা একটি গর্ভনিং কমিটি করার পরামর্শ দেন। আর এই কমিটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পান লোলিত মোদি। আইপিএল গভর্নিং কাউন্সিলের জন্য অফিস বানান নিজের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানকেই। সেখান থেকেই পরিচালিত হতে থাকে আইপিএলের সব কার্যক্রম।

বিসিসিআই থেকে অনুমতি পাওয়ার পর বেশ দ্রুতগতিতে আগাতে থাকে আইপিএলের আয়োজনের বিভিন্ন কার্যক্রম। এরই অংশ হিসেবে ১২ সেপ্টেম্বর, ২০০৭ দিল্লিতে এক মধ্যাহ্নভোজের আয়োজন করেন লোলিত মোদি। সেখানে উপস্থিত ছিলেন ভারতীয় দলের  দুই অভিজ্ঞ ক্রিকেটার রাহুল দ্রাবিড় এবং সৌরভ গাঙ্গুলি। এছাড়াও ছিলেন অজি ক্রিকেটার গ্লেন ম্যাকগ্রা এবং কিউই ক্রিকেটার স্টিফেন ফ্লেমিং।

সেখানে এই চার ক্রিকেটারের সাথে আইপিএল কি এবং কিভাবে আয়োজন করা হবে সেই বিষয়ে আলোচনা করেন লোলিত মোদি। এছাড়াও ক্রিকেটাররা কিভাবে আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারেন সেই বিষয়েও ধারণা দেন তিনি। যদিও তখনও আইপিএল আয়োজিত হবে কিনা সেই বিষয়ে ছিল না কোনো নিশ্চয়তা। ক্রিকেটারদের বিষয়গুলো বুঝিয়ে দেওয়ার পরেই এক সংবাদ সম্মেলনে এই আয়োজনের ঘোষণা দিয়ে বসেন লোলিত মোদি!

ঘোষণা দিলেও তখনও কারা দল কিনবেন বা কিভাবে ক্রিকেটারদের নিয়ে আসা হবে সেই বিষয়ে কোনো ধারণাই দেননি লোলিত মোদি। শুধু জানিয়ে দেন আসছে নতুন এক টুর্নামেন্ট। 

sportsmail24

টুর্নামেন্ট আয়োজনের ঘোষণার পর লোলিত মোদির সামনে চ্যালেঞ্জ ছিল ক্রিকেটারদের রাজি করানো। এর চেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল প্রথম সারির ক্রিকেটারদের আইপিএলে নিয়ে আসা। সে সময় বড় অঙ্কের ভিত্তিমূল্যে  শীর্ষ ১০০ ক্রিকেটারের তালিকা তৈরি করেন লোলিত মোদি।

টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের প্রথম আসরের আগেই ক্রিকেটারদের তালিকা তৈরি করেন। বিশ্বকাপ শুরু হলে ক্রিকেটাদের সাথে আলোচনা করতে সেখানে উড়ে যান। সেখানে বসেই ক্রিকেটারদেরকে বড় অর্থের বিনিময়ে দলে নেওয়া হবে বলে বোঝান। আর বেশিরভাগ ক্রিকেটারই রাজি হয়ে যান লোলিত মোদির এই প্রস্তাবে।

ক্রিকেটারদের রাজি করানোর পর আইসিসির সদস্য দেশগুলোর সাথেও আলোচনা করেন লোলিত মোদি। সেখানকার আলোচনার বিষয় ছিল আইপিএলের জন্য ক্রিকেটারদের ছাড়পত্র দেওয়া। সব দেশের ক্রিকেট বোর্ড রাজি হলেও এত দীর্ঘ সময়ের জন্য ইংলিশ ক্রিকেটাদের ছাড়তে রাজি ছিল না ইংল্যান্ড এন্ড ওয়েলস ক্রিকেট বোর্ড। শেষ পর্যন্ত ইংলিশ ক্রিকেটারদের ছাড়াই আইপিএল শুরুর প্রস্তাব করেন লোলিত মোদি।

ক্রিকেটারদের রাজি করানোর পর আইপিএলের ফ্রাঞ্চাইজি বিক্রির জন্য উঠে পড়ে লাগেন লোলিত মোদি। ক্রিকেটে বলিউড কিংবা কর্পোরেট জগত সবাইকেই অন্তর্ভূক্ত করতে মরিয়া ছিলেন। আইপিএলে সবার নজর টানতেই এই দুই জগতকে একত্রে করেছিলেন লোলিত মোদি। শেষ পর্যন্ত তার ডাকে সাড়া দেন বলিউড অভিনেতা শাহরুখ খান, অভিনেত্রী প্রীতি জিনতা-জুহি চাওলারা। এছাড়াও কর্পোরেট জগত থেকে লোলিত মোদির ডাকে সাড়া দেয় রিলায়েন্স গ্রুপ- ইন্ডিয়া সিমেন্টসের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো।

লোলিত মোদির এই আশায় বড় বড় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান এবং বলিউড সুপার স্টাররা দল কিনে নিলে পূর্ণতা পায় আইপিএলের আয়োজনের সবকিছু। শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা শুরু হয় আইপিএল মাঠে গড়ানোর। আর বড় বড় কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান আর বলিউডের সম্পৃক্ততার কারণে বেশ দ্রুতই আইপিএলের জন্য স্পন্সরও পেয়ে যায় বিসিসিআই। আর শেষ পর্যন্ত সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে লোলিত মোদির স্বপ্নের আইপিএল মাঠে গড়ায় ২০০৮ সালের  ১৮ এপ্রিল।

আইপিএল পরিকল্পনা চলাকালীনই টুর্নামেন্টের সম্প্রচার স্বত্ব বিক্রি করেছিলেন লোলিত মোদি। এমনকি বিক্রি করে দিয়েছিলেন ইভেন্ট স্বত্বও। শেষ পর্যন্ত মাঠে গড়িয়েছিল আইপিএল। শুধু তাই নয়, পরিণত হয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় ফ্রাঞ্চাইজি লিগে।

লোলিত মোদির শ্রম আর চিন্তার ফসল এই আইপিএল। সেখান থেকেই একে একে এসেছে বিশ্বের অন্য ফ্রাঞ্চাইজি লিগগুলো। এতেই বদলে গেছে ক্রিকেটের হালচাল। তাই তো একটা ধন্যবাদ পেতেই পারেন লোলিত মোদি।

স্পোর্টসমেইল২৪/পিপিআর


শেয়ার করুন :


আরও পড়ুন

ফুটবল মাঠে স্বাধীনতার সংগ্রাম

ফুটবল মাঠে স্বাধীনতার সংগ্রাম

মিথুন মানস : আক্ষেপ আর অপেক্ষা

মিথুন মানস : আক্ষেপ আর অপেক্ষা

নিলাম ঘরের ত্রাণকর্তা চারু শর্মা

নিলাম ঘরের ত্রাণকর্তা চারু শর্মা

শচীন ও দূর্ভাগা অমল: প্রতিভাবান হয়েও অর্জনের পার্থক্য আকাশ-পাতাল

শচীন ও দূর্ভাগা অমল: প্রতিভাবান হয়েও অর্জনের পার্থক্য আকাশ-পাতাল