মোশারফ রুবেল : জীবনযুদ্ধে পরাজিত লড়াকু এক যোদ্ধা 

পার্থ প্রতীম রায় পার্থ প্রতীম রায় প্রকাশিত: ১১:২৫ পিএম, ১৯ এপ্রিল ২০২২
মোশারফ রুবেল : জীবনযুদ্ধে পরাজিত লড়াকু এক যোদ্ধা 

মরণব্যাধি ক্যান্সারকে জয় করে ক্রিকেট মাঠে নতুন করে ফিরেছিলেন ভারতের বিশ্বকাপজয়ী অলরাউন্ডার যুবরাজ সিং। একই ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার পরও নিয়তি মোশারফ হোসেন রুবেলকে দেয়নি মাঠে ফেরার সুযোগ। ক্যান্সারের সাথে লড়াই করে জীবনের বাইশ গজে ক্লিন বোল্ড হয়ে ওপারে চলে গেছেন এই ক্রিকেটার। জীবনের বাইশগজ যে ক্রিকেটের বাইশ গজের মতো এতোটা সহজ নয় কিংবা বারবার সুযোগ মেলে না সেটাই প্রমাণ করেছেন মোশারফ রুবেল।

ক্রিকেট মাঠের মতো বেঁচে থাকার লড়াইয়ের নিজের সর্বোচ্চটুকু দিয়েই লড়াই করেছেন মোশারফ হোসেন রুবেল। তার এই লড়াইয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি), ক্রিকেটার মাশরাফি বিন মর্তুজা এবং সাকিব আল হাসানরা পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। তবুও, তাকে ধরে রাখা যায়নি। সব সম্পর্ক ছিন্ন করে জীবন নদীর ওপারে চলে গেছেন।

বাংলাদেশ ক্রিকেটের বড় কোনো তারকা ছিলেন না মোশারাফ হোসেন রুবেল। তবে তার মধ্যে ছিল সামর্থ্যের সবটুকু। বাংলাদেশকে বলা হয় বাঁহাতি স্পিনারদের খনি। আর সেখানে থেকে জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়া যে কঠিন সেটা বেশ ভালো করেই জানতেন। সিনিয়র হওয়ার পরও বয়সে ছোট আব্দুর রাজ্জাক, সাকিব আল হাসানদের সাথে পেরে উঠেননি। তাই জাতীয় দলে হতে পারেননি নিয়মিত। হয়তো নিয়মিত হতে পারতেন যদি না যোগ দিতেন নিষিদ্ধ ঘোষিত ইন্ডিয়ান ক্রিকেট লিগে (আইসিএল)।

হয়তো রাজ্জাক-সাকিবদের ছাপিয়ে বাংলাদেশের স্পিন আক্রমণের অন্যতম ভরসা হয়ে উঠতে পারতেন মোশারফ রুবেল। কিন্তু নিষিদ্ধ লিগে পাড়ি জমিয়ে সেই স্বপ্নকে কিছুটা ধূলিসাৎ করে ফেলেছিলেন। এরপরে যখন নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে ক্রিকেটের মূল স্রোতে ফেরার সুযোগ পেয়েছেন, নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন। চেষ্টা করেছেন নিজেকে প্রমাণ করবার।

sportsmail24

ঘরোয়া ক্রিকেটে রুবেল যখন রীতিমতো ভয়ংকর বোলার, সেই সময়ই জাতীয় দলে তার জন্য দরজা খুলে যায়। কিন্তু পারফর্ম করতে না পারায় বাদও পড়েছিলেন। একই সময়ে জাতীয় দলে থাকা তরুণ দুই স্পিনার সাকিব-রাজ্জাকের দারুণ পারফর্মেন্স তাকে জাতীয় দলের লড়াই থেকে পিছিয়ে দিয়েছিল। তবুও হাল ছাড়েননি, লড়াইয়ের মন্ত্রে উদ্দীপ্ত হয়ে মাঠে নেমে লড়াই করেছিলেন।

মোশারাফ রুবেল যে ছিলেন একজন প্রকৃত যোদ্ধা, যুদ্ধ করে আবারও জাতীয় দলে ডাক পেয়েছিলেন। দীর্ঘ আট বছর বিরতির পর আবারও জাতীয় দলে ফিরে আসেন। এইবারও জাতীয় দলে নিজের জায়গাটাকে করতে পারেননি পাকাপোক্ত। ঘরোয়া ক্রিকেটের সেই দারুণ ছন্দ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে টেনে আনতে না পারায় আবারও বাদ পড়েছিলেন।

৩৪ বছর বয়সে জাতীয় দল থেকে বাদ পড়ে অনেকে হয়তো ক্রিকেটটাই ছেড়ে দেওয়ার চিন্তা-ভাবনা করেন। তবে রুবেল সেই পথে হাঁটেননি। ক্রিকেট চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তেই অনড় ছিলেন। সেই সিদ্ধান্তে অনড় থেকেই জীবনের মায়া ত্যাগ করেছেন মোশারফ হোসেন রুবেল। আনুষ্ঠানিকভাবে প্রিয় ক্রিকেটকে বিদায় জানানোর আগেই যে, জীবন নদীর ওপারে চলে গেছেন তিনি।

জাতীয় দল থেকে বাদ পড়ে রুবেল যখন জাতীয় দলে ফেরার জন্য কঠোর পরিশ্রমে মত্ত, ঠিক সেই সময়ই ২০১৯ সালে জানা যায়, ব্রেন টিউমারে আক্রান্ত হয়েছেন। একের পর এক কেমোথেরাপি আর চিকিৎসায় সুস্থও হয়ে উঠেছিলেন তিনি। হয়তো যুবরাজ সিংয়ের মতো তিনিও চেয়েছিলেন মাঠে ফিরবেন। কিন্তু পূর্ণ সুস্থ হওয়ার পর ২০২১ সালা আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠে টিউমার। এবার আর সুস্থ হয়ে উঠতে পারেননি রুবেল, বিদায় নিয়েছেন অকালেই।

sportsmail24

২০০১ সালে পেশাদার ক্রিকেটে অভিষেকের পর ঘরোয়া ক্রিকেটে নিয়মিত পারফর্মার হতে সময় নিয়েছিলেন এক যুগ। ২০১৩ থেকে বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটের নিয়মিত পারফর্মার হয়ে উঠেন মোশারফ হোসেন রুবেল। বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগেও (বিপিএল) আলাদা করে নজর কেড়েছিলেন। এর পুরষ্কার স্বরুপ জাতীয় দলে পেয়েছিলেন জায়গা। তবে দুই ম্যাচেই শেষ হয়েছিল তার ওই জাতীয় দল যাত্রা।

ব্রেন টিউমারে আক্রান্ত হওয়ার পরও ক্রিকেট মাঠে ফেরার স্বপ্ন দেখেছিলেন। কিন্তু ব্রেন টিউমার তার সেই স্বপ্নকে কেড়ে নিয়েছে। শুধু কি তাই? সুন্দর গোছানো সংসার এবং মাথা গোঁজার ঠাইও ছিল তার। তবে এই ব্রেন টিউমার কেড়ে নিয়েছে তার সবকিছু। চেয়েছিলেন সব হারিয়ে সুস্থ থাকতে, তবে এই মরণব্যাধি রুবেলের সেই ইচ্ছা পূরণ করতে দেয়নি।

ওপারে পাড়ি জমানো এই বাঁহাতি স্পিনার ক্রিকেট মাঠে ছিলেন আলোক শিখার মতো উজ্জ্বল। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে খেলেছিলেন ১১২ ম্যাচ। এই সময় ৩৯২ বার ব্যাটারদের প্যাভিলিয়নে ফিরিয়েছিলেন। এছাড়াও সীমিত ওভারের ক্রিকেটে খেলেছিলেন ১০৪ লিস্ট ‘এ’ এবং ৫৬ টি-টোয়েন্টি ম্যাচ। এই দুই ফরম্যাটে তার নামের পাশে আছে যথাক্রমে ১২০ ও ৬০ উইকেট।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ব্লু’ ব্যাজধারী ছাত্র ছিলেন মোশারফ হোসেন রুবেল। পড়েছিলেন ইতিহাস। শুধু পড়াশুনা নয়, ক্রিকেট মাঠেও দারুণ মেধাবী ছিলেন মোশারফ হোসেন রুবেল। যে ক্রিকেটকে সারাজীবন ভালোবেসেছিলেন, বানিয়েছিলেন জীবিকা, সেই ক্রিকেট মাঠেই তার আর ফেরা হয়ে উঠেনি। ওপারে ভালো থাকবেন মোশারফ হোসেন রুবেল।

স্পোর্টসমেইল২৪/পিপিআর



শেয়ার করুন :


আরও পড়ুন

ফুটবল মাঠে স্বাধীনতার সংগ্রাম

ফুটবল মাঠে স্বাধীনতার সংগ্রাম

বাংলাদেশ ক্রিকেটের দুঃখ ‘শেষ বল’

বাংলাদেশ ক্রিকেটের দুঃখ ‘শেষ বল’

তারুণ্যের হাত ধরে বিশে বিশ্বজয়ের গল্প

তারুণ্যের হাত ধরে বিশে বিশ্বজয়ের গল্প

বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট : গল্পটা লাল-সবুজের জয়িতাদের

বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট : গল্পটা লাল-সবুজের জয়িতাদের