রমেশ কুমার : আইপিএলে টেনিস বলের ‘নারিন’

আরিফুল হক বিজয় আরিফুল হক বিজয় প্রকাশিত: ০৬:৫৭ পিএম, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২
রমেশ কুমার : আইপিএলে টেনিস বলের ‘নারিন’

আইপিএল শুধু একটি ক্রিকেট টুর্নামেন্ট নয়, কতজনের জীবনের মোড় বদলে দেয়া মহামঞ্চ। ভারতের অপরিচিত একটা ছেলে; যাকে কেউ কোনোদিন দেখেনি, চিনে না, জানে না। সেই ছেলেটাও আইপিলের মঞ্চে এসে নিজেকে জানান দিয়ে যায় ধ্রুবতারার ন্যায়। বিস্ময় না? দরিদ্রের কষাঘাতে জীবনের অনেকটা রূপ দেখে ফেলা ছেলেটাও আইপিএলে দেখে ফেলে জীবনের চূড়ান্ত রূপ। এবারের গল্পটাও রূপকথার!

বাবা জুতো মেরামতের কাজ করেন। মা চুড়ি বিক্রেতা। অভাবের সংসার। এই অভাবের সংসারেই বড় ছেলেটা মজে থাকে ব্যাট-বলের খেলায়। বাবা বাঁধা দেন। পড়াশোনা করতে বলেন। তখন কি আর সে জানতো এই ক্রিকেটই তার ছেলের ভাগ্য বদলে দিবে? তিনি না জানলেও ভাগ্যবিধাতা বোধহয় মুচকি হেসেছিলেন। নয়তো টেনিস বলে খেলা ছেলেটাকে আইপিএলের মঞ্চ হাতছানি দিয়ে ডাকবে কেন?

sportsmail24শুরুটা হয়েছিল টেপ টেনিসে এভাবেই সাফল্যের মধ্যে দিয়ে

ছেলেটার নাম রমেশ কুমার। সবাই ডাকে ‘নারিন জালালাবাদিয়া’। এবারের আইপিএলের নিলামে চমক ছিলেন এই রমেশ। বিশ লক্ষ টাকায় যাকে কিনে নিয়েছে কলকাতা নাইট রাইডার্স। রমেশের জীবন বদলে যাওয়ার পিছনে আছে ছয়টা বল বা একটি ওভার। যা তার দলকে শিরোপা জিততে সাহায্য করেছিল।

রমেশের ‘নারিন জালালাবাদ’ হওয়ার গল্পটা একটু ভিন্ন। ওয়েস্ট ইন্ডিজের স্পিনার সুনীল নারিনকে অনুকরণ করে বল করতেন রমেশ। নারিনের রহস্যময় বলগুলো ভালো লাগতো তার। সেই থেকে শুরু। এক ওভারে কিভাবে ছয়টা বলে বৈচিত্র্য এনে ছয়ভাবে করা যায় সেটার চেষ্টা করতেন। একসময় সেটা আয়ত্তেও এসে যায়। ব্যস, বিভিন্ন টেপ টেনিসের টুর্নামেন্টে শুরু হলো প্রয়োগ করা। সেখান থেকেই ভাগ্যের বদল শুরু।

রমেশের ভাগ্য বদলের পেছনে মানুষটার নাম গুরকিরাত্ মান। পাঞ্জাবের এই খেলোয়াড় আইপিএলে কলকাতার হয়ে খেলতেন। একদিন ইউটিউবে তার নজরে পড়ে রমেশের বোলিংয়ের ভিডিও। দেখে মুগ্ধ হয়ে যান মান। এরপর ভিডিওটি মান কলকাতার সহকারী কোচ ও মুম্বাইয়ের সাবেক খেলোয়াড় অভিষেক নায়ারকে দেখিয়েছিলেন। নায়ারও মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। তবে সন্দেহ ছিল ক্রিকেট বলে পারবেন কিনা!

sportsmail24রহস্যময় বোলিংয়ে জিতেছেন অনেক ট্রফি

একদিন পাঞ্জাবের সিনিয়র টিমের ক্যাম্প চলাকালীন রমেশকে মোহালির পিসিএ স্টেডিয়ামে ডাকেন মান। আশ্চর্যের বিষয় ছিল যে, রমেশ ক্রিকেট বলেও একদম হুবহু দক্ষতা দেখিয়েছিল। সেই বোলিংয়ের ভিডিও করে মান নিজেই নায়ারের ফোনে পাঠিয়েছিলেন। যে ভিডিওর বদৌলতে ভাগ্যের চাকা ঘুরে যায় রমেশের।

মোহালিতে ট্রায়াল দেয়ার কয়েকদিন পর রমেশের ফোনে অচেনা একটি নাম্বার থেকে কল আসে। রমেশ ভেবেছিলেন হয়তো কোনো জায়গা থেকে ঋণের জন্য কল দিয়েছে। কারণ তাদের পরিবারের কিছু ঋণ ছিল। কিন্তু তাকে যে অভিষেক নায়ারের মতো কেউ ফোন দিবেন সেটা মনের ভুলেও ভাবেননি এই তরুণ।

পরে রমেশ জানলেন সেটা সত্যিই অভিষেক নায়ার ছিল। রমেশ বলেন, ‘আমি ভেবেছিলাম এটা হয়তো কোনো ব্যাংক থেকে ব্যক্তিগত ঋণের জন্য কল ছিল। অভিষেক নায়ার কেন আমাকে ফোন করবেন? মান পাজি বলার পরই কেবল আমি আশ্বস্ত হয়েছিলাম যে সেটা আসলেই অভিষেক নায়ারের কল ছিল।’

sportsmail24এখান এসে বদলে যায় রমেশের জীবন

রমেশের জীবনে গুরকিরাত মানের ভূমিকা ঠিক শব্দ দিয়ে ব্যাখা করা যাবে না। টেপ টেনিসে খেলা এই তরুণের জীবনই ঘুরিয়ে দিয়েছেন মান। তাকে স্পাইক সু, প্রাকটিস কিট কিনে দেয়া থেকে শুরু করে মিনার্ভা পাঞ্জাব ক্রিকেট একাডেমিতে ভর্তি করেছিলেন মান। রমেশ পাঞ্জাবের বিখ্যাত জেপি আত্রে ক্রিকেট টুর্নামেন্টে মিনার্ভার হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেছেন। তিন ম্যাচ খেলে ১২টি উইকেটও নিয়েছিলেন তিনি।

গুরকিরাত মানের কথা বলতে গিয়ে রমেশ বলেন, ‘মান পাজির কাছে আমি ও আমার জীবন ঋণী। সে আমার জন্য অনেক কিছু করেছে। সে না থাকলে আমি শুধু টেনিস ক্রিকেটই খেলে যেতাম। তিনি আমাকে আর্থিকভাবে সাহায্য করেছেন। আমার ভিডিও শুট করেছেন এবং সবসময় আমাকে উৎসাহিত করেন।’

রমেশের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, আইপিএলের টাকা কিভাবে খরচ করবেন তিনি। জবাব দিয়েছেন দায়িত্ববান ছেলের মতো, ‘আমার মা জালালাবাদের গ্রামে চুড়ি বিক্রি করেন। আমি তার জন্য একটা দোকান করে দিবো। বাকি টাকা আমার ছোট দুই ভাইয়ের লেখাপড়ার জন্য সঞ্চয় করব। ওরা বড় মানুষ হোক।’

sportsmail24স্বপ্নের পথে পা বাড়ানোর শুরু রমেশ কুমারের

পঁচিশ বছর আগে রমেশের বাবা মঙ্গু রাম তার পরিবারের জন্য কাজ এবং একটি উন্নত জীবনের সন্ধানে রাজস্থানের হনুমানগড় ছেড়ে পাঞ্জাবের ফাজিলকা জেলার জালালাবাদে বসতি স্থাপন করেন। যে জীবনের আশায় তিনি বসতভিটা ছেড়েছেন, আজ সে জীবন তার দরিদ্রের ঘর আলোকিত করে তুলেছে।

এখন তার ছেলে বিশ্বের সবচেয়ে বড় টি-টোয়েন্টি লিগে কত বিখ্যাত খেলোয়াড়ের সঙ্গে কাঁধ মিলাবে। মঙ্গু রামের ছোট্ট কুটিরে আলো ছড়াবে ‘নারিন জালালাবাদিয়া’। যে আলোতে জ্বলজ্বল করবেন রমেশ কুমার।

স্পোর্টসমেইল২৪/এএইচবি

[আমরা এখন sportsmail.com.bd ঠিকানাতেও। খেলাধুলার সর্বশেষ সংবাদ পড়তে ইনস্টল করুন আমাদের অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল অ্যাপস ]


শেয়ার করুন :


আরও পড়ুন

তারুণ্যের হাত ধরে বিশে বিশ্বজয়ের গল্প

তারুণ্যের হাত ধরে বিশে বিশ্বজয়ের গল্প

বাংলাদেশ ক্রিকেটের দুঃখ ‘শেষ বল’

বাংলাদেশ ক্রিকেটের দুঃখ ‘শেষ বল’

বাংলাদেশে জনপ্রিয় ‘পাঁচ’ বিদেশি ক্রিকেটার

বাংলাদেশে জনপ্রিয় ‘পাঁচ’ বিদেশি ক্রিকেটার

বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট : গল্পটা লাল-সবুজের জয়িতাদের

বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট : গল্পটা লাল-সবুজের জয়িতাদের