ধর্মশালার শীতলতা ও মনোহর প্রকৃতি

জান-ই-আলম জান-ই-আলম প্রকাশিত: ১১:২৫ এএম, ১০ এপ্রিল ২০২০
ধর্মশালার শীতলতা ও মনোহর প্রকৃতি

ম্যাচের দিনে, ম্যাচের ভেন্যুতে আসলে যা হয় আর কী। তাও আবার অজানা, অচেনা জায়গা। সবচেয়ে বড় কথা হলো, এটা বিশ্বকাপ। ঘুমের চেষ্টা তাই তিরোহিত করতে হয়েছে নাস্তার পরপরই।

হোটেলের অভ্যর্থনা কক্ষে আইসিসির মিডিয়ার কর্মকর্তারা হাজির। সেখানে গিয়ে নিতে হয়েছে অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড, ম্যাচ ডে টিকিটসহ আনুষাঙ্গিক বিষয়াদি। সে পর্ব শেষ করতে করতে স্টেডিয়ামে যাওয়ার সময় এসে গেল। হোটেল থেকে ১৫ মিনিটেই ধর্মশালার হিমাচল প্রদেশ ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন স্টেডিয়ামে যাওয়া যায়।

ট্যাক্সিতে ওই পথ পাড়ি দিতে গিয়ে যতই এগিয়েছি, ততই যেন মুগ্ধতায় আছন্ন হয়েছে চোখ। বাঁকের পর বাঁক। ঠিক পুরাতন ঢাকার সরু গলি পথ নয়। ভালোই প্রশস্ত, তবে চওড়া গলি পথ বললে খুব বেশি অত্যুক্তি হবে না। মসৃণ রাস্তায় গাড়ির গতিবেগও ভালো। পাশ দিয়ে আবাল বৃদ্ধ-বনিতা হেঁটে যাচ্ছে। স্কুল-কলেজগামীরাই বেশি। পাহাড় কেটে রাস্তা হয়েছে সেটা স্পষ্ট। তাই তো কখনো গাড়ি উঠছে, কখনো নামছে। উঠানামা করতে হয় বলেই হয়তো সবার পায়ে কেডস। ছোট-বড় সবাই কেডস পায়ে চলেন। শীতও হয়তো কারণ হতে পারে।

ধর্মশালা শহরের রাস্তাগুলো এমনভাবেই বিন্যস্ত। যান্ত্রিক শহরের লেশমাত্রও নেই। নিরাপত্তার চ্যালেঞ্জ আছে বলে মোড়ে মোড়ে পুলিশ আছে। তবে শ’শ পুলিশ নয়, দুই-চার জন করে। প্রয়োজনীয় জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ট্যাক্সিকে রুট দেখিয়ে দিচ্ছেন পুলিশ সদস্যরাই। ধর্মশালা সরকারি কলেজের ভেতর দিয়ে সরু রাস্তা গিয়েছে। সেটা ধরেই আসতে হয় ধর্মশালার হিমাচল প্রদেশ ক্রিকেট স্টেডিয়ামের মিডিয়া গেইটে। কলেজের অভ্যন্তরে ছাত্র-ছাত্রী অনেক।

কিন্তু আশ্চর্য একটা নীরবতা সেখানে আছে। দেখলাম, জনা দশেকের একটা দল পিটি করছিল। হয়তো স্কাউট দল জাতীয় কিছু হবে। আর বাকিরা কলেজের প্রাচীরে পা ছড়িয়ে বসে আছে। প্রাচীরগুলোও বেশ উঁচু। আবার কেউ দাঁড়িয়ে আছে। কারণ ওই ছাদ থেকে দিব্যি চোখ রাখা যায় স্টেডিয়ামের সবুজ জমিনে। টিকিট ছাড়াই এসব ছাত্র-ছাত্রী বিশ্বকাপ ক্রিকেট দেখতে পান। তবে আগ্রহের কমতি নেই তাদের চোখে মুখে।

নিরুপদ্রব তল্লাশির পর স্টেডিয়াম চত্বরে পা রাখলাম আমরা। পুলিশ সদস্য আবার বলে দিচ্ছেন, ‘আপনারা বাংলাদেশের, মানে মিত্র মানুষ’। সত্যিই তো, বাংলাদেশ যে ভারতের প্রতিবেশি। সেই সূত্রেই হাসিমুখে পথ দেখিয়ে দিচ্ছেন নিরাপত্তাকর্মীরা। স্বেচ্ছাসেবকদের অভ্যর্থনা শেষে ক্রিকেট দুনিয়ার অন্যতম সৌন্দর্য মন্ডিত স্টেডিয়ামে প্রবেশাধিকার মিলল। তৃতীয় তলায় প্রেসবক্স, তথা আমাদের কর্মস্থল।

প্রেস বক্সে এসেই মনটা প্রশান্তিতে ভরে উঠল (পড়ুন উঠতে বাধ্য)। প্রেস বক্সের কাচ ভেদ করে মাঠের সবুজ গালিচা, ছোট্ট মাঠটার অন্যপ্রান্তে ড্রেসিংরুম, ভিআইপি বক্সসহ পুরো বিল্ডিংটা ডুপ্লেক্স বাড়ির মতো। সেই মুগ্ধতা কাটতে সেকেন্ডের ভগ্নাংশ সময় লাগেনি। ওই দূরে তাকাতেই, নয়ন জুড়ানোর আয়োজন উপস্থিত।

হিমালয়ের সুউচ্চ পাহাড়গুলো মোহনীয়তা ছড়ায় পলকে পলকে। পাহাড়ের উপরে বরফের শ্বেত শুভ্র আভা, এক কথায় অসাধারণ। দৃষ্টি এড়াবে না মেঘমালার প্রবাহ। পাহাড়ের গিরিখাতে গাছ-পালা রয়েছে। আছে জনবসতিও।

সাজানো সৌন্দর্যের সব দৃশ্যই চোখে পড়ে স্টেডিয়ামের প্রেসবক্স থেকে। ক্রিকেটকে ভুলিয়ে দিতে যথেষ্ট এ মনোমুগ্ধকর প্রকৃতি।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতেই হিম শীতল প্রবাহ শুরু হয়। শরীর ঠান্ডায় জমতে থাকে। তাপমাত্রা কমতে থাকে। এই মার্চেই দিল্লী, কলকাতায় অন্তত ২৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রা থাকে। ধর্মশালায় দিনে ১০-১২ ডিগ্রি হলে সন্ধ্যার পর ৮-৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে আসে। তবে ঠান্ডার আক্রমণসহ যাবতীয় সব অসাড় হয়ে যায় ধর্মশালার প্রাকৃতিক শিল্পিত সৌন্দর্যের সামনে।

ধর্মশালার প্রেস বক্সটা বেশ সুন্দর। মাঠটা ভালোই দেখা যায়। তখন প্রেস বক্সে আমরা বাংলাদেশি সাংবাদিকরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিলাম। সাড়ে ৩টায় শুরু হয় বাংলাদেশ-নেদারল্যান্ডস ম্যাচ। তামিম ইকবালের হাফ সেঞ্চুরিতে বাংলাদেশ ৭ উইকেটে ১৫৩ রান করে। যদিও ১৮০ রান করার সম্ভাবনা ছিল। অভিজ্ঞতায় পিছিয়ে থাকা ডাচরা হেরে যায় ৮ রানে। টাইগারদের পর ওমানের ঐতিহাসিক জয়ের স্বাক্ষীও হলাম আমরা। আইরিশদের ২ উইকেট হারিয়ে দেয় আইসিসি সহযোগী দেশ ওমান।

তবে ম্যাচ শুরু হওয়ার আগেই যন্ত্রণা, বিরক্তির উদ্রেক করে বসে ধর্মশালার প্রেস বক্স। ভোগান্তির নাম ‘ইন্টারনেট’, বর্তমান যুগে যেটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই যায় তো, এই আসে।

দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা কোনোভাবেই ইন্টারনেটের নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহ নিশ্চিত করতে পারছিলেন না। ম্যাচ চলাকালীন সাংবাদিকদের ইন্টারনেটের হাহাকার, রিপোর্ট না পাঠাতে পারার টেনশন, কর্মকর্তাদের ব্যর্থতার অসহায়ত্ব যেন একটা করুণ পরিস্থিতি তৈরি করেছিল। কিছু সময় ইন্টারনেট পাওয়া গেলেও তা এতই স্লো স্পিড যে, একটা ডক ফাইল অ্যাটাচ হতে মিনিট ১০-১৫ লেগে যেত।

সবার তাড়া দেখে কর্মকর্তারা বারবার বলেছেন, দেখছি দাদা, চলে আসবে ৫ মিনিট, ১০ মিনিট। কিন্তু হতাশার বিষয় হলো, ওই ৫-১০ মিনিট আর শেষ হয় না। এ দিকে সবার বিরক্তি, চিন্তা চরমে উঠেছে। শেষ অবধি ধীরগতির ইন্টারনেট মেনেই সবাই কাজে মনোযোগী হতে বাধ্য হই।

কাজ শেষ হতে হতে স্থানীয় রাত ১১টা পেরিয়ে গেছে। স্টেডিয়াম, প্রেস বক্সে থাকা অবস্থায় কিছু বুঝা যায়নি। দিনে মৃদু ঠান্ডা থাকলেও তা সহনীয় ছিল। এত রাতে প্রেসবক্স থেকে বের হতেই অবস্থাটা টের পাওয়া গেল। সারা শরীরে জেঁকে বসে শীত।

জ্যাকেট, সোয়েটার বেধ করে হিমশীতল প্রবাহ শরীরে কাঁপুনি তৈরি করছে। হিমাচল ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন অবশ্য বেশ ভালো যত্ন-আত্তি করেছে আমাদের। এমন বিরুদ্ধ পরিবেশে হোটেলে ফিরতে ট্যাক্সি ঠিক করে দিয়েছে। ‘বাবা’ নামে এক ড্রাইভারই কয়েক ট্রিপে আমাদের সবাইকে নামিয়ে দিয়ে আসতো।

মাঝ রাত, রাস্তাগুলো সুনসান। মাঝে মাঝে দু-একটা ট্যাক্সি চলছে। এমনটাই হওয়ার কথা। যে পরিমাণ শীত, তাতে অত রাতে বের হওয়ার মতো বোকামি কেইবা করতে চায়। আসলে ধর্মশালা শহরটা স্থবির হয়ে যায় ১০টার মাঝেই। কিছু কিছু খাবার হোটেল শুধু খোলা থাকে রাত ১২টা অবধি। স্টেডিয়ামেই ডিনার ছিল বলে ওই রাতে আর খাবারের সন্ধানে বের হতে হয়নি।

আষ্ঠেপৃষ্ঠে ঘিরে ধরা শীতের পরিমাণ কিছুটা কমলো হোটেল রুমে ফিরে। তাও আবার রুম হিটার চালানোর পর। ওয়াশ রুমে গিয়ে হাত-মুখ ধোয়ার চেষ্টায় যেন চপেটাঘাত খেতে হলো। এত ঠান্ডা পানি যেন বরফ হাতে-মুখে নিলাম।

কালবিলম্ব না করে তখনই পানির স্পর্শ ত্যাগ করতে হলো। পানি গরম করার যন্ত্র ছিল। সেটি ব্যবহার উপযোগী হতে ১৫-২০ মিনিট সময় লাগে। পরিশ্রান্ত দেহ তখন আর বাড়তি আড্ডাবাজি বা নিশি জাগাকে প্রশ্রয় দেয়নি। টি-শার্ট, সুয়েটার, দুটো কম্বল দিয়েও শীত নিবারণের চেষ্টা শেষে ঘুমের দেশে হারিয়ে যাওয়া।

চলবে...


শেয়ার করুন :


আরও পড়ুন

অপ্রতুল প্রস্তুতি, বড় অভিযাত্রা

অপ্রতুল প্রস্তুতি, বড় অভিযাত্রা

বন্ধন এমন বিশ্বাস যেমন

বন্ধন এমন বিশ্বাস যেমন

মিশন ধর্মশালা

মিশন ধর্মশালা

বিসিবির সকল পরিকল্পনায় টি-২০ বিশ্বকাপ

বিসিবির সকল পরিকল্পনায় টি-২০ বিশ্বকাপ