অপ্রতুল প্রস্তুতি, বড় অভিযাত্রা

জান-ই-আলম জান-ই-আলম প্রকাশিত: ০৭:২২ পিএম, ০৭ এপ্রিল ২০২০
অপ্রতুল প্রস্তুতি, বড় অভিযাত্রা

বেনাপোল সীমান্তে সেলফি, ২০১৬

৬ মার্চ (২০১৬) এশিয়া কাপের ফাইনালে ভারতের কাছে বাংলাদেশের পরাজয় তখনও সবার মাঝে জাগুরক। সেসব অবশ্য রাত পোহাতেই ঝেড়ে ফেলতে হয়েছে আমাদের। ৭ মার্চের সকালের নতুন সূর্যে শুরু করতে হয়েছে নতুন মিশনের যোগাড়-যন্ত। বলছি আমাদের ক্রীড়া সাংবাদিকদের কথা। দিনব্যাপী তাড়াহুড়োর প্রস্তুতিতেই সময় কেটেছে অধিকাংশের। বিশেষ করে আমাদের আটজনের।

আইসিসি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ২০১৬ কভার করতে ভারত যাব আমরা। সে যাত্রায় আমার সঙ্গী ছিলেন- দৈনিক মানবকণ্ঠের ক্রীড়া সম্পাদক মহিউদ্দিন পলাশ, দৈনিক ইনকিলাবের বিশেষ প্রতিনিধি শামীম চৌধুরী, দৈনিক জনকণ্ঠের সিনিয়র রিপোর্টার মিথুন আশরাফ, বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সিনিয়র স্পোর্টস রিপোর্টার আসিফ মাহমুদ তপু, প্রিয়ডটকমের স্পোর্টস রিপোর্টার শান্ত মাহমুদ, বাংলা ট্রিবিউনের স্পোর্টস রিপোর্টার রবিউল ইসলাম রবি ও রাইজিংবিডির স্পোর্টস রিপোর্টার ইয়াসিন হাসান রাব্বি।

আমাদের বহরটা দু-অংকের কোটা স্পর্শ করে বাস কাউন্টারে এসে। গ্রীন লাইনের বাসে আমাদের সাথে যোগ দেয় বাংলাদেশের ক্রিকেটের পরিচিত মুখ টাইগার শোয়েব ও টাইগারদের টিম বয় নাসির। আট সাংবাদিকের দলে বিদেশ ভ্রমণে অভিষিক্তর সংখ্যা চার। অভিষিক্তদের মাঝে আমার নামটাও আছে। শিহরণ, রোমাঞ্চ যাই বলুন, সেটা সহজেই অনুমেয়।

৭ মার্চ মাঝরাতে গ্রীন লাইনের বাসে চেপে শুরু হয় আমাদের আইসিসি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ২০১৬ মিশন। পাটুরিয়া ঘাটে ফেরির অপেক্ষায় ধল প্রহরের সময়টাও পার হয়ে গিয়েছিল।

ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। মাগুরা, যশোর পেরিয়ে আমাদের বাস বেনাপোলের পথ ধরেছে। জনপদ তখনও জেগে উঠেনি। মৃদুমন্দ শীতল বাতাসে কিছু কৃষক মাঠে চাষাবাদ শুরু করেছেন, মাছ ধরার জেলেরা জাল গোটাচ্ছেন, চায়ের দোকানি উনুন জ্বালাচ্ছেন আপন মনে।

প্রকৃতির অপূর্ব আয়োজন উপভোগের মধ্য দিয়ে পথ পাড়ি দিচ্ছিলাম। রোদ চড়ে উঠার আগেই বেনাপোল সীমান্তে পৌঁছে গেলাম আমরা। যথারীতি ভ্রমণকর পরিশোধ শেষে বাংলাদেশ ইমিগ্রেশন, কাস্টমসে ঢুকলাম। বলে রাখা ভালো- সেখানে যাওয়ার আগেই হাজির হয়েছিলেন ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা সেলিম ভাই। তার সঙ্গে পরিচয়টা হয়েছে আমাদের সুহৃদ, সাবেক সহকর্মী বর্তমানে গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআই-এর সহকারী পরিচালক আরিফ পলাশের মাধ্যমে। যৎ কিঞ্চিত ঝামেলা এখানে হয়ে থাকে ভ্রমণার্থীদের, সেসব আমরা টের পায়নি সেলিম ভাইয়ের কল্যাণে।

তারপর লাগেজ নিয়ে হাঁটা শুরু। ৫০ গজের বেশি হবে না। রাস্তার বুক চিরে ফাটল করা আছে একটু। হ্যাঁ, এটুকুই ব্যবধান। যা বাংলাদেশ-ভারতের বিভাজক। এপাড় বাংলাদেশ, ওপাড় ভারত। একটু উঁকি দিয়ে দূরে দৃষ্টি দিলে খুব বেশি ব্যবধান চোখে পড়ে না। দু-প্রান্তেই কোলাহল রয়েছে। শুধু বাংলাদেশের ইমিগ্রেশন কাস্টমস অফিসটা বিল্ডিংয়ের আধুনিকতায় সাজানো, আর পেট্রাপোলের (ভারত) ইমিগ্রেশন অফিস আধাপাকা বাড়ি। তাও ওদেরটা আসলে রাস্তার ঢালে, যেন ক্ষেতের ওপর।

কাঁটাতারের বেড়ি নেই। একটা লোহার গেইট শুধু। তার সামনেই চেয়ার পেতে বসে থাকা ভদ্রলোক পাসপোর্ট পরীক্ষা শেষে ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দিলেন।

হ্যাঁ, সীমান্ত পার হয়ে গেলাম। কয়েক কদমের ব্যবধানে আমরা বাংলাদেশের ভূখণ্ড ছেড়ে প্রতিবেশি ভারতের মাটিতে অবস্থান করছি। অগ্রবর্তী মানুষদের অনুসরণে সেই আধাপাকা বাড়িগুলোতে ঢুকলাম। সেখানে স্ক্যান মেশিন আছে, তারপরও দু’জন কর্মকর্তা ব্যাগ, লাগেজ পরীক্ষা করে দেখছেন। সৌভাগ্যক্রমে আমিসহ কয়েকজন সেই ঝক্কিতে পড়িনি। লাগেজে কী আছে, জিজ্ঞাসা করেই যেতে দিয়েছেন আমাদের।

সেখান থেকে যেতে হলো খোলা একটা জায়গায়। বাড়ির উঠান বলতে পারেন। দাঁড়িয়ে থাকতে হলো লাইনে ছাউনি বিহীন উঠানে। এর মাঝেই মিথুন আশরাফ প্রয়োজনীয় কিছু কাগজ সংগ্রহ করে আনলো সবার জন্য। ধাবমান লাইন পেরিয়েই ইমিগ্রেশন অফিসের দেখা মিললো। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষের টিভিতে চলছে ভারতীয় চ্যানেল।

ইমিগ্রেশন কর্মকর্তারা কিছু জিজ্ঞাসাবাদ, গন্তব্যস্থান, ক্যামেরায় ছবি তুলে সিল মেরে চলে যাওয়ার অনুমতি দিচ্ছেন সবাইকে। কিন্তু বিপত্তি বাধে আমাদের বেলায়। সাংবাদিক দেখে ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা তার সিনিয়রকে বিষয়টি জানান। আকাল বুদ্ধির ঢেঁকি সেই কর্মকর্তা সবার কাগজপত্র দেখতে চাইলেন। আমরা পাসপোর্টে ভিসা, আইসিসি-বিসিবির ভিসা সাপোর্ট লেটারসহ আনুসাঙ্গিক কাগজপত্র দেখালাম। তাতে তার মন ভরেনি!

তিনি জানতে চাইলেন, দাদা আপনাদের আমন্ত্রণ পত্র কই? অনুসন্ধিৎসু চোখে বললেন, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ বুঝলাম, হাইকমিশন ভিসা দিছে বুঝলাম, কিন্তু ভারত সরকারের আমন্ত্রণপত্র কই? ওটা ছাড়া আপনারা ঢুকতে পারবেন না!

আমাদের সবার তো চোখ ছানাবড়া। একি বলে! যেখানে হাইকমিশন ভিসা দিছে, ভিসায় উল্লেখ আছে ‘ফর টি-টোয়েন্টি ওয়ার্ল্ডকাপ’ সেখানে আমন্ত্রণপত্র আবার কী? এসব তো লাগে না। সে লোক নাছোড়বান্দা, বুঝবার পাত্র নন।

এক কথা, দু-কথায় অনেক কণ্ঠ এক হয়ে পড়ায় শোরগোল বাড়লো। এমন সময় টলতে টলতে এক কর্মকর্তা এলেন, আওয়াজ শুনে কি-সব যেন বলে গেলেন, তার কথা ছিল অস্পষ্ট (মদ্যপ বলে মনে হয়েছিল)। খুব ভালো কথা বলেননি, এটুকু নিশ্চিত।

এর মাঝে আবার ওই কর্মকর্তা (সেই গোয়ার গোবিন্দ) ওঠে সব ইমিগ্রেশন অফিসারকে বলে দিলেন, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ছাড়া সাংবাদিকদের যেতে দেবেন না কেউ।

বিশাল ভুড়ি সম্পন্ন মাতালের পাঠ চুকাবার পর আমাদের শামীম ভাই ওই ভদ্রলোককে আবার বোঝানো শুরু করেন। এ সময় দ্বরাজ কণ্ঠের অধিকারী শামীম ভাইয়ের গলার স্বর চড়ে বসে সপ্তমে। ঘটনার আবহ ততক্ষণে ছড়িয়েছে ইমিগ্রেশন অফিসের অন্যান্য রুমেও। চিৎকার, চেঁচামেচি সহ্য করতে না পেরেই হয়তো এগিয়ে এলেন এক বড়কর্তা (পড়ুন আমাদের উদ্ধারকর্তা)।

গোটা বিষয়টা জানার পর তিনি আমাদের সবার পাসপোর্ট দেখলেন। ওই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এক বাক্যেই বলে দিলেন, ওনাদের ভিসা দেওয়া হয়েছে বিশ্বকাপের জন্য, ভিসায় লেখা আছে। আর কোনো কাগজপত্র লাগবে না। ওই কথার পরও সেই ঝামেলা প্রিয় লোকটা সিনিয়রকে উল্টো-পাল্টা বুঝানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু বড়কর্তা ভদ্রলোক বেশিক্ষণ না থেকে সিদ্ধান্ত দিয়ে চলে গেলেন।

এবার নতজানু হয়ে সেই গোয়ার গোবিন্দই আবার ঘোষণা দিল, সাংবাদিকদের দ্রুত ছেড়ে দেন, আর কোনো কাগজ লাগবে না।

অহেতুক ঝামেলায় কেটে গেল ঘণ্টা খানেক। ইমিগ্রেশনের বাকি পর্ব সারলাম দ্রুতই। তারপর একে একে খোলা মাঠের মতো পথ ঘুরে ওঠে যাই রাস্তায়। যেখানে অপেক্ষমাণ আছে আমাদেরকে কলকাতা নিয়ে যাওয়ার গ্রীন লাইন বাস।

বলা ভালো, সেটি ভারতীয় সংস্করণের গ্রীন লাইন। বাংলাদেশের সংস্করণের সঙ্গে মিল নেই। বাসের কাউন্টারে যেতেই পাসপোর্ট দেওয়া, ভারত অংশের ভাড়া পরিশোধ করার ঘোষণা এলো। হেল্পাররা লাগেজ গাড়িতে তুলছে। রোদ তখন মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। আর প্রাতরাশের টান সবার চোখে মুখে বিরাজ করছে।

কাউন্টারের বাইরেই মিললো সিম কেনা, রুপি কেনার সব আয়োজন। সেসবও করলো সবাই নিজের মতো করে। তারপর প্রাতরাশের পালা। একটা হোটেলে গিয়ে বসে পরোটা (আমাদের পুরি বলতে পারেন, তবে আকার বড়), সবজির অর্ডার করা হলো, সঙ্গে চা। তাড়া ছিল, কারণ বাস ছাড়ার তাগিদ অনবরত চলছেই। আমাদের জন্যই নাকি অপেক্ষা। ঠিক গোগ্রাসে না হলেও খুব বাছ-বিচার ছাড়াই খাবার গিলতে হলো সবাইকে।

উল্লেখ করতেই হয়, এখান থেকেই শুরু সর্বত্র জিরা-ধনিয়ার উৎপাত। তরকারি, ভাজি, চা-যাই খান; জিরা বা ধনিয়ার উপস্থিতি আপনি টের পাবেনই। অতৃপ্তির প্রাতরাশ শেষে সবাই ওঠে পড়লাম বাসে।

চলবে...


শেয়ার করুন :


আরও পড়ুন

স্থবির ক্রীড়াঙ্গন, সাংবাদিকদের জন্যও বড় চ্যালেঞ্জ

স্থবির ক্রীড়াঙ্গন, সাংবাদিকদের জন্যও বড় চ্যালেঞ্জ

ক্যাপ্টেন, আপনাকে ধন্যবাদ

ক্যাপ্টেন, আপনাকে ধন্যবাদ

আয়ে ভাটা, পুষিয়ে নেওয়ার সম্ভাবনা দেখছে বিসিবি

আয়ে ভাটা, পুষিয়ে নেওয়ার সম্ভাবনা দেখছে বিসিবি

দেশে সবধরনের ক্রিকেট অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ

দেশে সবধরনের ক্রিকেট অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ