তাসকিন-সানিকে মাশরাফির অশ্রুসজল বিদায়

জান-ই-আলম জান-ই-আলম প্রকাশিত: ১০:৪৭ এএম, ১৯ এপ্রিল ২০২০
তাসকিন-সানিকে মাশরাফির অশ্রুসজল বিদায়

ব্যাঙ্গালুরু এসে তৃতীয় দিনে (১৯ মার্চ, ২০১৬) অনুশীলনে নেমেছিল বাংলাদেশ। আমাদেরও চিন্নাস্বামী স্টেডিয়ামে পদার্পণ সেদিনই প্রথমবার। কড়া রোদে অনুশীলনের পর সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছিলেন জাতীয় দলের কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে। তখন ২১ মার্চ অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ম্যাচ নিয়েই পরিকল্পনা করছিল বাংলাদেশ। এই লঙ্কান কোচ বলেছিলেন, সুপার টেন পর্বে কম্বিনেশন নিয়ে নাকি অস্ট্রেলিয়া দল বিভ্রান্ত রয়েছে। কারণ প্রথম ম্যাচে নিউজিল্যান্ডের কাছে হেরেছিল স্টিভেন স্মিথের দল।

বলা বাহুল্য, এর মাঝে ব্যাঙ্গালুরুর গান্ধীনগরের শ্রী ত্রুপতি কমফোর্টস হোটেলে ধীরে ধীরে বাংলাদেশি সাংবাদিকদের সংখ্যাটা বেড়েছে। কয়েকদিনের মাঝেই সময় টিভির রিপোর্টার হুমায়ন কবির রোজ ও সময় টিভির ক্যামেরাপারসন, দৈনিক যুগান্তরের স্পোর্টস রিপোর্টার জ্যোর্তিময় মন্ডল জ্যোতি, বাংলা টিব্রিউনের স্পোর্টস রিপোর্টার রবিউল ইসলাম রবি, রাইজিং বিডির স্পোর্টস রিপোর্টার ইয়াসিন হাসান রাব্বি, দীপ্ত টিভির রিপোর্টার নাহিদ আশরাফ রাজীব এসে উঠলো এই হোটেলে। সবমিলিয়ে পরিবেশটা সবার জন্যই বেশ আনন্দঘন হয়ে উঠেছিল।

যদিও দেশের বাইরে এতগুলো চেনামুখ একসাথে থাকার স্বস্তি ও ভালোলাগার আনন্দে হতাশার প্লাবন নেমে এসেছিল ২০ মার্চ সকালেই। আগের দিন বিকেল থেকেই গুঞ্জনটা ছড়িয়েছিল। শুধু আনুষ্ঠানিক ঘোষণার অপেক্ষা ছিল। দিনের প্রথমভাগেই বাংলাদেশ দল ও আমাদের বিশ্বকাপ মিশনে বিষাদের ছায়া নেমে আসলো।

সকাল ৯টা, ঘুম থেকে উঠেছি মাত্র। ওঠেই মেইল ওপেন করলাম। দেখি আইসিসির মেইল। সেখানেই লেখা আছে, তাসকিন আহমেদ ও আরাফাত সানির বোলিং অ্যাকশন অবৈধ ঘোষণা করেছে আইসিসি!

দারুণ ফর্মে থাকা দুই বোলারের বিশ্বকাপ শেষ হয়ে গেল মাঝপথেই। সেই ধাক্কার তীব্রতা বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দলের পরের ম্যাচগুলোতে খুব ভালোভাবেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল।

খবরটা জানার পর খুব দেরি না করে আমরা ছুঁটে যাই স্টেডিয়ামে। বাংলাদেশ দলের অনুশীলন আছে। তারপর অনুশীলন শেষে পরদিন (২১ মার্চ) ম্যাচের জন্য সংবাদ সম্মেলন রয়েছে অধিনায়ক মাশরাফির।

বিসিবি আগেই জানতে পেরেছিল বলে বদলি হিসেবে শুভাগত হোম ও সাকলাইন সজীবকে প্রস্তুত রেখেছিল। আগের দিন সন্ধ্যায় রওনা দিয়ে কলকাতা হয়ে সকালে ব্যাঙ্গালুরুতে পৌঁছেছেন তারা। ভ্রমণের ধকল না কাটতেই অনুশীলনে নামেন দু’জনেই।

গোটা দল আলাদা অনুশীলন করছিল। আর শুভাগত-সাকলাইন একটি নেটে পরস্পরকে বোলিং, ব্যাটিংয়ে সাহায্য করলেন। অনুশীলন শেষে মিডিয়া ম্যানেজার রাবিদ ইমাম অনেকক্ষণ অধিনায়ক মাশরাফির সঙ্গে মাঠের এক কোণে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আলাপ করেন। সেই আলাপের বিষয়বস্তু যে খানিক পরের সাংবাদিক সম্মেলনের বক্তব্য, তা বুঝতে বাকি রইলো না।

অনুশীলনে বাংলাদেশ দলটাও কেমন যেন ছন্নছাড়া ছিল। যেন কোনো কিছুতেই প্রাণ নেই। তাসকিন তো মাঠেই আসেননি। আরাফাত সানি আসলেও অনুশীলন করেননি। শুধু সতীর্থদের সঙ্গে এক জায়গায় বসে গল্প করে সময় কাটিয়েছেন এই বাঁহাতি স্পিনার।

চিন্নাস্বামী স্টেডিয়ামের সংবাদ সম্মেলন কক্ষ বেশ বড়। তবে মিরপুর স্টেডিয়ামের মতো গোছালো অবশ্যই নয়। সেই কক্ষ পুরোটাই সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে পরিপূর্ণ। তারপর মিনিট পচিশেকের জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলন যেন, কক্ষের জনতাকে ঘোরের মাঝে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল।

হ্যাঁ, আজন্ম স্মরণীয় সেই সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের অধিনায়ক মাশরাফি নিজে কেঁদেছেন, কাঁদিয়েছেনও। প্রশ্ন-উত্তর পর্ব চলার সময় শুরু থেকেই চোখ ছলছল করছিল মাশরাফির। যেন এখনই দুকূল ছাপিয়ে প্লাবন বইবে। ২০১১ সালের পর আবারও অশ্রুসজল মাশরাফিকে দেখলাম।

সংবাদ সম্মেলন কক্ষ ত্যাগ করার সময় অশ্রুধারা বইতে শুরু করে তার চোখে। যা কোনো কিছুতেই বাধ মানছিল না। অঝোর ধারায় কাঁদছেন মাশরাফি। পুরো দল হোটেলে চলে গিয়েছিল। অধিনায়কের হোটেলে ফেরার ব্যবস্থা ম্যানেজার খালেদ মাহমুদ সুজনের সঙ্গে গাড়িতে। সেই গাড়িতে উঠেও অশ্রু সংবরণ করতে পারেনি বাংলাদেশের অধিনায়ক।

বাইরে থেকে সাংবাদিকরাও সাহস দিচ্ছিলেন। বারবার হাত দিয়ে চোখ মুছতে ছিলেন মাশরাফি। কিন্তু এটি যেন থামার নয়। কারণ, এটি বেদনাহত, হৃদয় চূর্ণ হওয়ার অশ্রু। সংবরণের চেষ্টা সেখানে ব্যর্থ অস্ত্র।

মাশরাফির কান্নায় বিগলিত চিন্নাস্বামী স্টেডিয়ামে উপস্থিত জনতা। বিদেশি সাংবাদিক, স্টেডিয়ামের কর্মকর্তা কাকে রেখে কার কথা বলবেন। সবাই যেন মাশরাফির হৃদয়ভাঙা কাহিনীর অংশ। সমব্যাথী তার অন্তরের ব্যথার, হৃদয়ের রক্ত ক্ষরণের।sportsmail24
কলকাতার প্রসিদ্ধ দৈনিক বর্তমানের সিনিয়র সাংবাদিক রবীন্দ্র চৌধুরী জয়। কলকাতার মানুষ। সংবাদ সম্মেলন শেষে রীতিমতো হাউমাউ করেই কেঁদে উঠলেন এ বাঙালি। বারবার বলছিলেন, এমন দৃশ্য আমি জীবনেও দেখিনি রে ভাই। দলের খেলোয়াড়দের জন্য এমন টান, এমন ভালোবাসা কোথাও দেখিনি। ক্রিকেট ইতিহাসে এ ঘটনা কোথাও হয়নি।

তাসকিন-সানির বিদায়টা কিভাবে ছুঁয়েছিল মাশরাফিকে, সেটির কিছুটা আঁচ পাবেন তার একটি বক্তব্য তুলে দিলে। সংবাদ সম্মেলনে ধরে আসা কণ্ঠে অধিনায়ক বলেছিলেন, ‘ঘরের দুইজন ছেলের যদি সমস্যা হয়, আপনি যেকোন কাজই ভালোভাবে করতে পারবেন না। সেই উদ্যমটা আর পাবেন না। আমাদের কাছে জিনিসটা এখন ওই রকম। আমাদের মানসিক অবস্থা এখন ওইরকম নেই। সবাই দেখলেই বুঝতে পারবেন।’

ক্যারিয়ারে দ্বিতীয়বার এমন প্রকাশ্যে কাঁদতে দেখলাম মাশরাফিকে। ২০১১ সালে ঘরের মাঠে বিশ্বকাপ দল থেকে বাদ পড়ায় কেঁদেছিলেন বাংলাদেশের অমূল্য সম্পদ এই ক্রিকেটার। এবার তার অশ্রুতে ভিজলো চিন্নাস্বামীর মাটি।

আরাফাত সানির বিষয়টা মেনে নিলেও মাশরাফি বারবার বলছিলেন, তাসকিনের বোলিং অ্যাকশন বৈধ আছে। তাছাড়া ফেব্রুয়ারিতে এশিয়া কাপ থেকেই দারুণ ফর্মে ছিলেন এই তরুণ পেসার। বিশ্বকাপের শুরু থেকেও অসাধারণ বোলিং করছিলেন তাসকিন। ইনজুরি আক্রান্ত মোস্তাফিজকে না পাওয়ায় গতির ঝড় তোলা তাসকিনেই বড় ভরসা পেয়েছিল বাংলাদেশ দল।

আবেগে ঠাসা এক সংবাদ সম্মেলন শেষে বিষন্ন বদনে আমরা হোটেলে ফিরি। মাশরাফির কান্না হৃদয় ছুঁয়ে গেলেও তা নিয়ে বসে থাকার ফুরসত নেই আমাদের। ঠিকই অন্তর নাড়িয়ে দেওয়া সংবাদ সম্মেলনের ইতিবৃত্ত লিখতে হয়েছিল সবাইকে।

চলবে...

সবগুলো পর্ব পড়তে ক্লিক করুন- ভারত ভ্রমণের দিনলিপি


শেয়ার করুন :


আরও পড়ুন

লালবাগ বোটানিক্যাল গার্ডেনে এক বেলা

লালবাগ বোটানিক্যাল গার্ডেনে এক বেলা

দালাইলামার মন্দিরে সাকিব ভক্ত

দালাইলামার মন্দিরে সাকিব ভক্ত

মাশরাফির নানার শরীরে করোনাভাইরাস

মাশরাফির নানার শরীরে করোনাভাইরাস

গাঙ্গুলির প্রশংসার অর্থ পরে বুঝেছিলেন ম্যাককালাম

গাঙ্গুলির প্রশংসার অর্থ পরে বুঝেছিলেন ম্যাককালাম