দালাইলামার মন্দিরে সাকিব ভক্ত

জান-ই-আলম জান-ই-আলম প্রকাশিত: ১০:৫২ এএম, ১২ এপ্রিল ২০২০
দালাইলামার মন্দিরে সাকিব ভক্ত

ধর্মশালার নয়নাভিরাম প্রকৃতিকে উপেক্ষা করা কঠিন। দর্শনীয় সব জায়গা আছে এখানে। ম্যাচগুলো দুপুরে বলে সকালের সময়টা কাজে লাগানোর পরিকল্পনা ১০ মার্চ রাতেই করেছিলাম আমরা। ১১ মার্চ সকালে ঘুম ভেঙে দেখলাম বৃষ্টি থামছে না।

প্রায় ১০টা নাগাদ বৃষ্টির তীব্রতা কমে আসে। হোটেলের ম্যানেজারের সাহায্যে পেয়ে গেলাম ট্যাক্সি। হিমাচল প্রদেশ ক্রিকেট স্টেডিয়ামটা ধর্মশালার সবচেয়ে নিচু অঞ্চলে বানানো হয়েছে। পাহাড়ের ভাঁজ বেয়ে যত উপরে ওঠা যায় ততই প্রকৃতির নৈসর্গিক সৌন্দর্যে পুলকিত হওয়ার সুযোগ মিলে।

আমাদের গন্তব্য ম্যাকলয়েডগঞ্জ। যেখানে থাকেন তিব্বতীদের ধর্মীয় গুরু ‘দালাইলামা’। ১৯৮৯ সালে যিনি নোবেল পুরস্কারও পেয়েছিলেন তিব্বতের বৌদ্ধদের অধিকার আদায়ে অবদানের জন্য। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি মাথায় নিয়েই ‘দালাইদামা’র আবাসস্থল তথা ধর্মশালায় বৌদ্ধদের মন্দির দেখতে বের হয়েছিলাম আমরা ক’জন।

ক্রমশই খাড়া হতে চলা রাস্তা বেয়ে উঠতে হয়। ট্যাক্সি ড্রাইভার সুরিন্দর জানালো, গাড়ি সবসময় ফার্স্ট গিয়ারেই চালাতে হয়। কিছু কিছু বাঁক, উঁচু খাড়া রাস্তা দেখলেই মনে ভয় চলে আসে। যদি পড়ে যাই! নাহ, তেমন কিছু হয় না। সুরিন্দরদের মতো দক্ষ ড্রাইভার রয়েছে। যারা এখানে গাড়ি চালিয়ে অভ্যস্ত।

সুরিন্দর যেখানে ট্যাক্সি থামাল সেটা ভূ-পৃষ্ঠ থেকে ১৭৫০ মিটার উঁচু। নিচু হয়ে সমতলে তাকালে বুকের ভেতর কাঁপন ধরতে বাধ্য। যদিও রাস্তায়, দোকানে মানুষের চলাচল দেখে চঞ্চলমতি মনে স্বাভাবিকতার ছোঁয়া আসে। বিশাল জায়গা নিয়ে গড়ে ওঠা কয়েক তলার বিল্ডিংগুলো দালাইলামার মন্দির নামেই পরিচিত।

গেট ঠেলে ঢুকতেই ফটকের সামনে একটি সাইনবোর্ড। সেখানে ১৫ বছরের এক যুবার ছবি সাঁটানো আছে। সঙ্গে তিব্বতী ও ইংরেজি ভাষায় লেখা বড় বর্ণনা। ‘পাঞ্চাননামা’ হিসেবে পরিচিত এ যুবক। মাতৃভূমির জন্য মিছিলে গিয়েছিলেন তিনি। তারপর ১৯৯৫ সালে হারিয়ে যান। পরে আর ফিরে আসেননি। তিব্বতীরা তাকে বলে থাকে দুনিয়ার সবচেয়ে কম বয়সী কয়েদী।

তারপরই চোখে পড়ে তিব্বতীদের ঐতিহ্য, সংগ্রামকে ধারণ করা জাদুঘর। তার সামনেই রয়েছে তিব্বতের জাতীয় শহীদদের স্মৃতিতে নির্মিত মনুমেন্ট। জাদুঘরে তিব্বতীতের ইতিহাস আগাগোড়াই জানা যায়। ছবিসহ সাজানো পরিপাটি জাদুঘর। মুভি দেখার ব্যবস্থাও রয়েছে। ২০০০ সালে এটি উদ্বোধন করেন দালাইলামা নিজে। জাদুঘরের কর্মকর্তা শ্রী বিং জানিয়েছিলেন, জাদুঘরের উদ্দেশ হচ্ছে ভারত বর্ষ ও বাইরের ভ্রমণকারীদের তিব্বতীদের সম্পর্কে জানানো।

তিব্বতের স্বাধীনতার দাবি অনেক পুরনো। চীন, ভুটান, ভারত, মায়ানমার, কিরগিস্তান বেষ্টিত তিব্বত। নিজ ভূমির স্বাধীনতার দাবিতে গত ২০০৮ সাল থেকে ১৪৩ তিব্বতী নিজেকে নিজে আগুনে জ্বালিয়ে দিয়েছেন। সেগুলোর পেছনে আছে চার কারণ।

শ্রী বিং বলেছিলেন, তিব্বতের প্রতি চীনের দমনমূলক নীতি, বাজে মানবাধিকার অবস্থা, আবহাওয়ার ক্ষতি, ঐতিহ্যের আত্তীকরণ করার চেষ্টা করে চীন। যা সবই তিব্বতের বিরুদ্ধে যায়।

ধর্মশালা থেকে তিব্বতের মূল ভূমির দূরত্ব ১ হাজার কিলোমিটার। মূলত তিব্বতের বড় অংশটা চীনের অধীনেই রয়েছে। ধর্মশালায় আছে ৫ হাজার তিব্বতী। তারা তিব্বতেই থাকতে চায়। স্বাধীন তিব্বতই এখানকার মানুষের প্রাণের দাবি।
sportsmail24
জাদুঘর দর্শন শেষ। ততক্ষণে দর্শনার্থীর সংখ্যাও বাড়ছে এখানে। তারপর আমরা সবাই পা বাড়াই মন্দিরের দিকে। ফটকেই মিললো নিরাপত্তা কর্মীদের। আবশ্যক তল্লাশি চালালেন তারা। গলায় ঝোলানো টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড দেখতেই যেন তাদের দৃষ্টি প্রখর হলো।

এক নিরাপত্তা কর্মী হিন্দিতেই প্রশ্ন করলেন। প্রশ্নটা বাংলা করলে হয় এমন, আপনারা কি বাংলাদেশি? উত্তরে, হ্যাঁ বললাম। এবার ওই নিরাপত্তা কর্মী বলেন, আপনারা কি ঢাকার, মিরপুরের?

বুঝতে বাকি নেই, ক্রিকেটের কল্যাণে মিরপুর তথা শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের নামটা এরাও জানে। মানে ক্রিকেটের আবেগ এমন ধর্মীয় পবিত্র স্থানেও রমরমাভাবে উপস্থিত।

একের পর এক প্রশ্ন তাদের। বাংলাদেশ নিয়ে, বাংলাদেশের ক্রিকেট নিয়ে। বিশেষ করে মহিলা নিরাপত্তাকর্মী বলে উঠলেন, বাংলাদেশ ক্রিকেট দল আমাদের খুব প্রিয়। আমরা বাংলাদেশকে সমর্থন করি।

গোয়া নামক আরেক নিরাপত্তাকর্মী জানালেন, তার প্রিয় ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান। বাংলাদেশের এ অলরাউন্ডার বিশ্বসেরা সেটাও তার অজানা নয়।

বৌদ্ধ ধর্মালম্বীদের তীর্থস্থানে বসেও ক্রিকেটের আবেগ থেকে দূরে নন তিনি। মাশরাফিদের ভালো করেই চিনেন গোয়া। ক্রিকেটের আলাপচারিতার পর্ব শেষ হতেই সানন্দচিত্তে ভেতরে প্রবেশের রাস্তা ধরিয়ে দিলেন এরা। কোথায় কীভাবে যেতে হবে সেটিও জানিয়ে দেন।

দালাইলামা এখানেই থাকেন। একটা হলুদ রঙ করা ঘরে। সেটি বন্ধ। কারণ দালাইলামা তখন যুক্তরাষ্ট্রে ছিলেন। দালাইলামার বসার স্থানটা বেশ আর্কষণীয়। গোটা স্থানে একটা নীরবতা বিরাজ করছে। বৌদ্ধদের ধর্মীয় কাজের ব্যবস্থা রয়েছে। আছে অনেকগুলো পিতলের তৈরি গোলাকৃতি জাতীয় ফাঁপা ঢোল। তবে এগুলো দু’দিক থেকে খোলা। এবং মাঝখানে লোহার রড বসানো। এগুলো হাত দিয়ে ঘোরানো যায়। দেখলাম দর্শনার্থীরা সবাই যাওয়ার সময় এগুলো ঘোরাচ্ছেন। কথিত আছে, স্রষ্টার কৃপা পাওয়ার জন্যই নাকি এমনটা করেন সবাই।

তিব্বতের বৌদ্ধদের কৃষ্টি, ঐতিহ্য, ধর্মীয় গাম্ভীর্যের নির্যাস নিয়েই ফেরার পথ ধরতে হয় আমাদের। হোটলে ফিরে আসি আমরা জুম্মার নামাজের আগে। শুক্রবার বলে বিদেশ-বিভূইয়েও জুম্মার নামাজটা পড়তে বের হলাম আমি ও মহিউদ্দিন পলাশ ভাই। স্থানীয় লোকজনদের পরামর্শ মতো হাঁটতে থাকি। ক্রমশ উপরেই ওঠতে হচ্ছে। তারপর ঢালু হয়ে নামা একটা সরু গলির শুরুতে টিনের পাটাতন দিয়ে তৈরি করা মসজিদের সন্ধান পেলাম। অজু করেই এসেছিলাম। ইমাম তখন বয়ান করছিলেন। সংখ্যায় কম তবে আমাদের কল্পনার চেয়ে অনেক বেশি মুসলিম ধর্মালম্বী দেখলাম মসজিদে এসে।

নামাজ শেষে স্টেডিয়ামে যাওয়াটা সুখকর হয়নি বৃষ্টি নামায়। সেই বৃষ্টি নেদারল্যান্ড-ওমান ম্যাচটি বাতিল করে দেয়। বাংলাদেশ-আয়ারল্যান্ড ম্যাচটা শুরু হলেও স্থায়ী হয়েছিল মাত্র ৮ ওভার। অনেক চেষ্টার পরও অব্যাহত বৃষ্টির কারণে বল আর মাঠে গড়ায়নি। এ ম্যাচটিও পরিত্যক্ত হয়। তবে এ ম্যাচেও বাংলাদেশ একাদশে রেখেছিল তাসকিনকে।

দিনের দুটি ম্যাচই পরিত্যক্ত হওয়ায় ‘এ’ গ্রুপ থেকে সুপার টেন পর্বে যাওয়ার দৌড় থেকে ছিটকে পড়ে নেদারল্যান্ডস ও আয়ারল্যান্ড। তখন বাংলাদেশ-ওমান ম্যাচটিই হয়ে পড়ে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন নির্ধারক।

আগের রাতের মতোই বৃষ্টি, হাড় কাঁপানো শীত নিয়ে স্টেডিয়াম থেকে মাঝ রাতে ফিরতে হয় হোটেলে। রাতের খাবার শেষে আবারও আড্ডাবাজি।

১২ মার্চ শনিবার সকালটা অলস সময় কেটেছে আমাদের। খাওয়া ও ঘুমই ছিল মূল কাজ। এদিন সকালেই বোলিং অ্যাকশনের পরীক্ষা দিতে চেন্নাই গেলেন আরাফাত সানি। বাংলাদেশের ম্যাচ না থাকলেও আমরা স্টেডিয়ামে যাই। জিম্বাবুয়েকে ৫৯ রানে হারিয়ে ‘বি’ গ্রুপ থেকে সুপার টেন পর্বে উন্নীত হয় আফগানিস্তান। দিনের অপর ম্যাচে হংকংকে হারায় স্কটল্যান্ড।

চলবে...


শেয়ার করুন :


আরও পড়ুন

বন্ধন এমন বিশ্বাস যেমন

বন্ধন এমন বিশ্বাস যেমন

মিশন ধর্মশালা

মিশন ধর্মশালা

ধর্মশালার শীতলতা ও মনোহর প্রকৃতি

ধর্মশালার শীতলতা ও মনোহর প্রকৃতি

স্বাধীনতাকামী তিব্বতী ও ঘটনার ঘনঘটা

স্বাধীনতাকামী তিব্বতী ও ঘটনার ঘনঘটা