শেন বন্ড : অকালে হারানো তাসমান সাগরপাড়ের গতিদানব

আরিফুল হক বিজয় আরিফুল হক বিজয় প্রকাশিত: ০৪:০৫ পিএম, ৩০ জানুয়ারি ২০২২
শেন বন্ড : অকালে হারানো তাসমান সাগরপাড়ের গতিদানব

দু’জনের জীবনের গল্পটা প্রায় একই রকম। প্রায় একই সময়ে বাইশগজের সবুজ গালিচায় আগুনে গতিতে বিশ্বকে চমকে দিয়ে দু’জনের আগমন। মাসটা একই, নভেম্বর। অথচ দৃশ্যপটটা ভিন্ন। সেদিন গায়ে কৈশোরের গন্ধ নিয়ে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে দৌড় শুরু করলেন নড়াইলের এক দুরন্ত কিশোর। ঠিক তখনি হাজার মাইল দূরের তাসমান সাগরপাড়ের হোবার্টে সবুজ গালিচায় গতির ঝড় তুললেন অন্যজন।

বলা হচ্ছিলো মাশরাফী এবং শেন বন্ডের কথা। গতিতে বিশ্বকে চমকে দিয়ে হুট করে থেমে যেতে হলো একটা সময়। ফাস্ট বোলারদের চিরসঙ্গী চোট-আঘাতের সঙ্গে দু'জনেরই দারুণ সখ্যতা। দু'জনের পথ বাঁক খেয়ে চলে গেছে দু’দিকে। যেখানে মাশরাফি একজন লড়াকু যোদ্ধা আর বন্ড অকালে হারানো তাঁরা।

শেন বন্ডের ক্রিকেটে আসার গল্পটা অন্যরকম। শুরুতে অবশ্য ক্রিকেটেই ছিলেন। প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট খেলে আসছিলেন বেশ। কিন্তু জাতীয় দলের দরজার কড়াটা বেশ ভালোভাবেই আটকে গেছে। ভালো খেলেও কোনোমতেই খুলতে পারছিলেন না সেই দরজা! হতাশ হয়ে পড়লেন বন্ড। আশা ছেড়ে দিয়ে যোগ দিলেন নিউজিল্যান্ডের পুলিশ বাহিনীতে। সেখানে গিয়েও অবশ্য ছাড়তে পারেননি ক্রিকেটের নেশা!

ক্রিকেটেই যে তার বসতি সেটা বুঝতে কেবল খানিকটা সময় লেগেছিল। তবে বুঝে গিয়েছিলেন বন্ড। কপালে যার ক্রিকেটের লিখন, খন্ডাবার সাধ্যি কার? পুলিশে গিয়েও অবসর সময়ে তাই নেমে পড়তেন বল হাতে। সপ্তাহে একদিন ছুটি পেতেন। একদিনে কি আর তৃপ্তি মিটে? আরও বেশি কিভাবে খেলা যায় তার একটা উপায় বের করে ফেললেন। একদিন একদিন করে ছুটি জমিয়ে সব একসাথে নিয়ে নিতেন। এভাবেই চলছিল জীবন। কিন্তু পরিপূর্ণ স্বাদটা পাচ্ছিলেন না। এরপরের গল্পটা শেন বন্ড নয়, যেন জেমস বন্ডের।

জেমস বন্ডকে কে না চেনে? হলিউডের দুর্দান্ত এক রহস্যময় চরিত্র। তাঁর মারাত্মক সব কৌশলের কথা কারো অজানা নয়। কৌশলের সাথে বুদ্ধির চমৎকার মিশেলে জেমস বন্ড হয়ে উঠেছিলেন অন্যান্য এক চরিত্র। গতির সাথে সুইংয়ের মারাত্মক ফাঁদ পেতে শেন বন্ডও হয়ে উঠেছিলেন বাইশগজের জেমস বন্ড।

কেবল গতিই নয়, বলকে নিপুণ কায়দায় সুইং করিয়ে তৈরী করতেন কৌশলের এক মারাত্মক ফাঁদ। তাতে পা দিয়ে কতজন যে ধরাশয়ী হয়েছেন তার ইয়ত্তা নেই, হিসেব মেলানো ভার। জেমস বন্ডের সাথে আরেকটা মিল আছে শেন বন্ডের। তা হলো, জেমস বন্ডের সিনেমার মতোই থ্রিলার অ্যাকশনে ভরপুর ছিল শেন বন্ডের ক্যারিয়ারও। মারদাঙ্গা স্টাইলে দুর্দান্তভাবে শুরু, মাঝে হোঁচট খাওয়া অতঃপর থেমে যাওয়া।

শেন বন্ডকে ধরা হতো কিউই কিংবদন্তি স্যার রিচার্ড হ্যাডলি পরবর্তী সময়ের সেরা গতিতারকা হিসাবে। যে কিনা প্রতিপক্ষের শিরদাঁড়ায় ভয়ের শীতল স্রোত বইয়ে দিতে পারতেন। আক্ষরিক অর্থের সাথে বাস্তবেও হয়েছিল তাই। শেন বন্ডের সেরা সময়ে তার সামনে নাস্তানাবুদ হননি, এমন ব্যাটার খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। শর্ট রানআপে ঘন্টায় ১৪৫ কিলোমিটার কিংবা তারও অধিক গতির বল সামলানো তো চাট্টিখানা কথা নয়।



শেন বন্ড ব্যাটারদের কাছে দুঃস্বপ্ন হয়ে উঠেছিলেন আরেকটা কারণে। তাঁর সেই টো ক্রাশিং ইয়র্কার। ইনসুইংয়ের সাথে ইয়র্কারের যুগলবন্দিতে ছুঁড়ে মারা একেকটা বল ব্যাটারদের জন্য হয়ে উঠেছিল স্রেফ মরণাস্ত্র। সে সময়ে ক্রিকেট বিশ্বের পেস ব্যাটারির বারুদটা ছিল শোয়েব আখতার আর ব্রেট লি'র দখলে। এই দুইজনের সাথে তখন একই কাতারে উচ্চারিত শেন বন্ডের নামও। বরং খানিকটা বেশিই উচ্চারিত হতো।

ফাস্ট বোলিংয়ের সৌন্দর্য্য ফুটিয়ে তুলতে আরো অনেক ব্যাপারই নিজের আয়ত্তে নিয়েছিলেন বন্ড। তাঁর ইনসুইং ডেলিভারিটা ছিলো একদম ন্যাচারাল। আর আউটসুইংটা হতো ভয়ংকর। সেই সঙ্গে যোগ করা যাক পুরনো বলে রিভার্স সুইং। এক্সপ্রেস গতির সাথে রিভার্স সুইং, ভাবা যায়? রীতিমতো নাড়িয়ে দিতেন স্ট্যাম্প। তবে বন্ডের সবচেয়ে যে বড় গুণটা ছিল একই লাইন লেংথে ক্রমাগত বোলিং করে যাওয়া। যা সে সময়ে আর কারো ছিল না। এখনকার সময়ে যে কাজটা করে যাচ্ছেন তারই উত্তরসূরী নেইল ওয়াগনার।



ইনজুরি বারবার টেনে ধরেছে, দীর্ঘায়িত করতে পারেননি ক্যারিয়ার । নয় বছরের ক্যারিয়ারে টেস্ট খেলতে পেরেছেন মাত্র ১৮টি! তাতেই উইকেট নিয়েছেন ৮৭টি, গড় মাত্র ২২.০৯! স্ট্রাইক রেট ৩৮.৭! ৮২ ওয়ানডেতে তাঁর শিকার ১৪৭ উইকেট। এছাড়া ২০ টি আন্তর্জাতিক টি২০ ম্যাচে বন্ডের উইকেট সংখ্যা ২৫। ইকোনমি রেট মাত্র ৭! খুব ছোট একটা ক্যারিয়ার, ছোট ছোট পরিসংখ্যান অথচ কি উজ্জ্বল আর গভীরতা।

গতির নেশা ভয়ংকর! এই গতির নেশাটাই শেষ পর্যন্ত কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল শেন বন্ডের জন্য। দশ কি বারো কদম দৌড়ে এসে চমৎকার অ্যাথলেটিক স্টাইলে বলটা ছুড়তেন বটে কিন্তু এর ভয়ংকর দিকটা বোধহয় জানতেন না বন্ড। যখন জানলেন ততদিনে অ্যাকশন বদলে ফেলেও লাভ হয়নি। সময়ের কাঁটায় মধ্যাহ্ন গগন পেরিয়ে ক্যারিয়ারের আলোটা চলে গেছে অপরাহ্নে। আলোটা অপরাহ্নে চলে গেলেও বন্ড রয়ে গেছেন তার সৃষ্টিশীলতায় চিরসবুজ। রয়ে গেছে তার সম্পর্কে বহুল প্রচলিত একটি উক্তি, ‘For New Zealand, he was their new Richard Hadlee. For the world, he was Bond, Shane Bond.’

স্পোর্টসমেইল২৪/এএইচবি

[আমরা এখন sportsmail.com.bd ঠিকানাতেও। খেলাধুলার সর্বশেষ সংবাদ পড়তে ইনস্টল করুন আমাদের অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল অ্যাপস ]


শেয়ার করুন :


আরও পড়ুন

কুসংস্কার ও পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই করা প্রথম নারী রেফারির গল্প

কুসংস্কার ও পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই করা প্রথম নারী রেফারির গল্প

প্রতিভার নিদারুণ অপচয় এক গুরাভ

প্রতিভার নিদারুণ অপচয় এক গুরাভ

রি-ক্রিয়েটিভো : স্প্যানিশ ফুটবলের পতাকাবাহক

রি-ক্রিয়েটিভো : স্প্যানিশ ফুটবলের পতাকাবাহক

অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ : ‘বি’ গ্রুপের নজরে ভারত-দক্ষিণ আফ্রিকা

অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ : ‘বি’ গ্রুপের নজরে ভারত-দক্ষিণ আফ্রিকা